রিক্সাওয়ালার সাথে পালিয়ে বিয়ে করার অপরাধ: ২৭ দিন ধরে জেল খাটছে প্রেমিকযুগল : একের পর এক দেয়া হচ্ছে মামলা
জালাল আহমদ : রিক্সাচালকের সাথে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করার অপরাধে ২৭ দিন ধরে সিলেট জেলহাজতে রয়েছে প্রেমিকযুগল। একের পর এক মামলা দেয়া হচ্ছে প্রেমিক রিক্সাওয়ালার বিরুদ্ধে। এসব মামলা করেছেন প্রেমিকার ভাই ও তাদের আত্মীয়-স্বজন। সিলেট ও মৌলভীবাজারে এ পর্যন্ত ৫টি মামলা করা হয়েছে। একর পর এক মামলার ফলে দিশেহারা রিক্সাওয়ালার অসহায় পরিবারের সদস্যরা মানবাধিকার সংস্থাসহ প্রশাসনের সুদৃষ্টি কামনা করেছেন।
সূত্র জানায়, মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার রামপাশা গ্রামের মরহুম সৈয়দ আব্দুল মতিন মাস্টারের ছেলে সিলেট শিড়্গা বোর্ডের অডিট কর্মকর্তা সৈয়দ আব্দুল হাকিম তাহমীর বোন সৈয়দা সামিনা উম্মুল এহসান ভালবেসেছিল বাড়ির কাজের ছেলে রিক্সাচালক একই গ্রামের মোসত্মফা মিয়ার পুত্র কামাল মিয়াকে। চলতি বছরের ২৩ মার্চ বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে পরদিন ২৪ মার্চ সিলেট নোটারী পাবলিকের মাধ্যমে উভয়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। এর পরদিন ২৫ মার্চ সিলেট সিটি কর্পোরেশনস্থ কাজী অফিসের মাধ্যমে ২ লাখ টাকা দেনমোহরের মাধ্যমে ইসলামী শরিয়া মোতাবেক বিয়ে হয় তাদের। কিন্তু রিক্সাওয়ালার সাথে ভালবেসে বিয়ে মেনে নিতে পারেননি সামিনার পরিবার। ২৫ মার্চ সামিনার চাচাতো ভাই সৈয়দ সালেহ আহমদ কমলগঞ্জ থানায় জিডি (নং-১০৩৯) করেন। ডায়রি করেন। জিডিতে উলেস্নখ করা হয় ২২ মার্চ দিবাগত রাতে পরিবারের কাউকে কিছু না বলে বাড়ি থেকে সৈয়দা সামিনা উম্মুল এহসান পালিয়ে যায়। পরবর্তীতে সামিনার পরিবারের সদস্যরা সামিনাকে অপহরণ ও নগদ অর্থ এবং স্বর্ণালংকার লুটপাটের অভিযোগ করলে ২৯ মার্চ বিকেলে সৈয়দা সামিনা উম্মুল এহসান কমলগঞ্জ থানায় হাজির হয়ে জানায় যে, তাকে কেউ অপহরণ করেনি। নিজ ইচ্ছায় ভালবেসে সে ঘর ছাড়ে এবং প্রেমিক কামালকে বিয়ে করে সংসার করছে। এ সময় নিজের নিরাপত্তা চেয়ে কমলগঞ্জ থানায় আবেদন করে সে। পুলিশ আবেদন আমলে নিয়ে ৩০ মার্চ দুপুরে নিরাপত্তা হেফাজতে প্রেরণের জন্য আদালতে সোপর্দ করলে সিনিয়র জুডিসিয়াল ২নং আমলি আদালত মৌলভীবাজার এর বিচারক সামিনাকে নিরাপত্তা হেফাজতে না পাঠিয়ে তার নিজ জিম্মায় প্রদানের জন্য কমলগঞ্জ থানা পুলিশকে নির্দেশ দেন। পরে সামিনার ইচ্ছায় ওইদিন সন্ধ্যায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও মহিলা উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে সামিনাকে তার শ্বাশুড়ি জবা বেগমের জিম্মায় দেয়া হয়। ওই রাতেই স্বামী কামালকে নিয়ে সিলেটের গোলাপগঞ্জ বাজারের জমির পস্নাজায় বসবাস করছিলো সে।
গত ৭ এপ্রিল সন্ধ্যায় সামিনার ভাইদের সহযোগিতায় ওই বাসা থেকে তাদেরকে আটক করে গোলাপগঞ্জ থানা পুলিশ। এ সময় সামিনা আদালতের আদেশ, বিয়ের কাগজপত্রসহ প্রয়োজনীয় প্রমাণাদি প্রদানের পরও তার ভাই সিলেট শিড়্গা বোর্ডের অডিট কর্মকর্তা সৈয়দ আব্দুল হাকিম তাহমীর চাপে তাদেরকে ছাড়েনি পুলিশ। এরপর ৮ এপ্রিল তাদেরকে আটক দেখিয়ে ৯ এপ্রিল সকালে সিলেট কোর্টে হাজির করে পুলিশ। আদালতে তাদের জামিন প্রার্থনা করা হলে সিনিয়র জুডিসিয়াল ১নং আমলি আদালতের বিজ্ঞ বিচারক তাদের জামিনের ওপর ১৫ এপ্রিল শুনানির দিন ধার্য করেন এবং সামিনাকে সিলেট বাঘবাড়ি নিরাপত্তা হেফাজতে ও কামালকে সিলেট জেলহাজতে প্রেরণের নির্দেশ দেন।
অভিযোগ রয়েছে, আদালতে হাজিরের দিন ওই বিচারকের সঙ্গে মৌলভীবাজার আদালতের জনৈক বিচারক দেখা করেন। ওই বিচারক সামিনার ভাই সৈয়দ আব্দুস হাকিম তাহমীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বিচারের সঙ্গে ওইদিন খাস কামরায় সৈয়দ আব্দুস হাকিম তাহমীরও ছিলেন বলে প্রত্যড়্গদর্শীরা জানিয়েছেন। গত ১৫ এপ্রিল মামলার শুনানি শেষে আদালত তাদের জামিন নামঞ্জুর করেন। ফলে গত ২৬ দিন ধরে জেল খাটছেন প্রেমিকযুগল সামিনা ও কামাল। এদিকে ২৪ এপ্রিল সিলেটের বিয়ানীবাজারের সুপাতলা এলাকার রুহুল আমিন নামের এক ব্যক্তি বাদী হয়ে প্রেমিক কামাল ও তার আত্মীয় আশিক মিয়ার বিরুদ্ধে বিয়ানীবাজার থানায় একটি মামলা করেন। মামলার এজাহারে উলেস্নখ করা হয়, বিগত ৫-৬ বছর ধরে তার বাসায় কাজ করছিল কামাল। গত ২৩ মার্চ ভোরে কামাল ও তার আত্মীয় মিলে বাসার আলমিরা ভেঙ্গে নগদ ২০ ভরি স্বর্ণালংকার ও নগদ ১ লাখ ২০ হাজার টাকা লুট করে নিয়ে যায়। থানার পাশেই এতো বড়ো চুরির ঘটনা ঘটলেও মামলা হয় এক মাস পরে। অথচ এ ঘটনা সম্পর্কে স্থানীয়রা কিছুই জানেন না। ওই মামলা দেখিয়ে সিলেট দড়্গিণ সুরমা থানা পুলিশ নিয়ে সিলেটের জৈনপুর বাড়ি থেকে ২১ এপ্রিল রাতে আটক করা হয় কামালের আত্মীয় আশিককে। পরে দড়্গিণ সুরমা থানা পুলিশ ৫৪ ধারায় তাকে আদালতে পাঠায়।
অপরদিকে মৌলভীবাজার চীফ জুডিশিয়াল আদালতসহ বিভিন্ন স্থানে সামিনার স্বামী কামাল মিয়া ও তার আত্মীয় স্বজনদের বিরুদ্ধে মারধর, টাকা পয়সা ও স্বর্ণালংকার লুটপাটের অভিযোগে একের পর এক মামলা করা হয়। সর্ব শেষ গত ১৭ এপ্রিল নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুনাল মৌলভীবাজার আদালতে ১৫৭/১৩ পিটিশন মামলা করা হয় কামাল ও তার আত্মীয় স্বজনদের বিরুদ্ধে। মামলার বাদী সামিনার ভাই সৈয়দ আব্দুল হাই আলফি। এ মামলারও ঘটনার তারিখ ২৩ মার্চ। মামলাটি বর্তমানে তদন্ত করছে মৌলভীবাজার জেলা ডিবি পুলিশ। এর আগে চীফ জুডিশিয়াল মৌলভীবাজার কোর্টে আরেকটি পিটিশন মামলা করেন আলফি। ১০৯/১৩ পিটিশন মামলাটি বর্তমানে তদন্ত করছেন কমলগঞ্জ থানার ওসি নিজেই। ওই মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, বিগত ৫-৬ বছর ধরে তার বাড়িতে কাজ করছিল কামাল। গত ২৩ মার্চ রাত ১০টার দিকে কামালসহ অন্যান্য আসামীরা ২০ ভরি স্বর্ণালংকার ও নগদ ১ লাখ ২০ হাজার টাকা লুট করে নিয়ে যায়।
এদিকে বিয়ানীবাজার থানায় দায়েরকৃত মামলায় আটক কামাল ও আশিককে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৫ দিনের রিমান্ড আবেদন করেছে পুলিশ। একের পর এক মামলা দায়েরের কারণে বর্তমানে কামালের আত্মীয়-স্বজনরা হয়রানিমূলক মামলার ভয়ে আতংকে দিন কাটাচ্ছে। প্রতিটি মামলায় একই অভিযোগ করা হয়েছে। একের পর এক মামলার কারণে সর্বস্বান্ত কামালের পরিবার। বর্তমানে ওই পরিবারের সদস্যরা মানবেতর দিন যাপন করছে। অপরদিকে সামিনার ভাইয়ের নানা চাপ ও তৎপরতার কারণে আটক যুগলপ্রেমিক কামাল ও সামিনার পড়্গের আইনজীবি বর্তমানে মামলা পরিচালনায় সাহস হারিয়ে ফেলেছেন এমন গুঞ্জনও আদালত পাড়ায় চলছে। এসব ঘটনায় ন্যায় বিচারের আশায় মানবাধিকার সংস্থাসহ প্রশাসনের প্রতি জোর দাবি জানিয়েছেন কামালের পরিবারের সদস্যরা।