কমলগঞ্জে ২০ টি চা বাগানে ২০ দফা দাবী আদায়ে চা শ্রমিকদের কর্ম বিরতি পালিত
পিন্টু দেবনাথ, কমলগঞ্জ : দৈনিক মজুরী ১২০ টাকা, চা শ্রমিক ইউনিয়নের নির্বাচন, লেবার হাউজ দখলমুক্তকরণ, ভিটা উচ্ছেদ আইন বাতিল করা, চা ছাত্র বৃত্তি পূনচালুসহ ২০ দফা দাবী আদায়ের লক্ষ্যে মঙ্গলবার থেকে ফাঁড়ি চা বাগানসহ মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার ২০ টি চা বাগানে সাধারন চা শ্রমিকরা একযোগে কর্ম বিরতি পালন করে। বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন সংগ্রাম পরিষদের ডাকে মঙ্গলবার সকাল থেকে এ ধর্মঘট শুরু হয়েছে। কর্মবিরতি সফল করতে সকাল থেকে চা বাগানগুলোতে মিছিল ও সমাবেশ করছেন শ্রমিকরা। দেশের সবগুলো চা বাগানে চা শ্রমিকরা একযোগে কর্ম বিরতি পালন করলে চা শিল্পে বড় ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা করছেন চা বাগান ব্যবস্থাপকরা। শুধুমাত্র কমলগঞ্জ উপজেলার দেওড়াছড়া ও নন্দরানী চা বাগানে কর্মবিরতি পালিত হয়নি বলে জানা গেছে। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত এ ধর্মঘট চলবে। শ্রমিকদের ২০ দফার মধ্যে উল্লেখযোগ্য দাবিগুলো হলো-চা শ্রমিক ইউনিয়নের নির্বাচন, শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি, বেকারদের কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও বাসস্থানের সু-বন্দোবস্ত, কৃষি জমি বেদখল মুক্তকরণ, বছরে ২০ দিন ছুটি, ছয় মাস মাতৃত্বকালীন ছুটি এবং বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা।
মঙ্গলবার সকাল ১০ টায় সরেজমিন কমলগঞ্জ উপজেলার শমশেরনগর, আলীনগর, পাত্রখোলা, মাধবপুর, মদনমোহনপুর, চাম্পারায় ও কুরমা চা বাগান ঘুরে দেখা যায়, কাজে যোগ না দিয়ে কারখানা ও অফিসের বাইরে অবস্থান নিয়ে কর্মবিরতি পালন করছে। চা শ্রমিকরা বিক্ষোভ মিছিল ও পথ সভা করে। আন্দোলনরত চা শ্রমিকরা জানান, ২০০৮ সনের ২ নভেম্বর প্রথম সাধারন চা শ্রমিকরা সরাসরি ভোট প্রদান করে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করেছিল। এ নির্বাচিত প্রতিনিধিরা প্রথমবারের মত শ্রীমঙ্গলস্থ চা শ্রমিক ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় কার্যালয় লেবার হাউজের দায়িত্ব গ্রহন করে এক বছরের মধ্যে চা শ্রমিকদের মজুরী ৩২ টাকা ৫০ পয়সা থেকে বৃদ্ধি করে ৪৮ টাকা করেছিল। বছরে দু’টি উৎসব বোনাস ৫০০ টাকা থেকে বৃদ্ধি করে ১২০০ টাকা করেছিল। যখন সাধারন চা শ্রমিকদের কল্যাণে কিছুটা কাজ করা হলে ২০০৮ সনে নির্বাচনে পরাজিত শক্তি (বিজয় প্রসাদ বুনার্জি) ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক প্রভাবে ২৫ নভেম্বর ২০০৯ সনে লেবার হাউজ থেকে সরিয়ে জবর দখল করে নেয়। সেই থেকে চা শ্রমিকদের ভাগ্যে শুরু হয় নিপিড়ন।
কমলগঞ্জের আলীনগর চা বাগানের আন্দোলনরত চা শ্রমিক রাজ কিশোর কৈরী, সজল কৈরী, রাধা কিশোর লোহার, বাঘাছড়া চা বাগানের সাধারন চা শ্রমিক রাখাল গোয়ালা, পাত্রকলা চা বাগানের শ্রমিক মোবারক হোসেন ও আলীনগর চা বাগানের শ্রমিক গনেশ পাত্র জানান, নির্বাচিত কমিটিকে লেবার হাউজ থেকে গায়ের জোরে সরানোর পরও ১ সেপ্টেম্বর ২০১১-তে সাধারন চা শ্রমিকরা চা বাগান মালিক পক্ষের কাছে ২০ দফা পূরণ করার দাবী জানিয়েছিল। এ দাবীগুলোর মাঝে উল্লেখযোগ্য ছিল, অবিলম্বে লেবার হাউজ দখলমুক্ত করা, দৈনিক মজুরী ১২০ টাকা করা, চা বাগানে ভিটা উচ্ছেদ আইন বাতিল করে ভূমি অধিকার প্রতিষ্ঠা করা, চা শ্রমিক সন্তানদের শিক্ষা বৃত্তি পূণঃ চালু করণ,চাকুরী ক্ষেত্রে ও শিক্ষা গ্রহন ক্ষেত্রে চা শ্রমকিদের কোটা রাখা ।
প্রায় দুই বছরেও এই ২০ দফা আদায় হয়নি। উল্টো চা শ্রমিকরা আরো নিপিড়িত হচ্ছে। তাই বাধ্য হয়ে মঙ্গলবার থেকে একযোগে চা শ্রমিকরা কর্ম বিরতি পালন শুরু হয়। বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের নির্বাচিত সাধারন সম্পাদক রাম ভজন কৈরী জানান, বাধ্য হয়ে মঙ্গলবার দল মত নির্বিশেষে সকল চা বাগানের সাধারণ চা শ্রমিক একজোট হয়ে এ কর্ম বিরতির পালন করছে। চা শ্রমিক ইউনিয়নের নির্বাচিত সকল প্রতিনিধিরা এ আন্দোলন কর্মসূচীর প্রতি সমর্থন জানায়। রাম ভজন কৈরী আরও বলেন, কমলগঞ্জে মনু-ধলই ভ্যালি (অঞ্চলের) ২২টি চা বাগানে কর্ম বিরতি পালননহ বিক্ষোভ মিছিল হয়। সিলেট ভ্যালির ২৫টি চা বাগানের মাঝে ২১ টি চা বাগানে এ কর্ম বিরতি পালন হয়। জুড়ি ভ্যালিতে ৩৪ টি চা বাগানের মাঝে ৩০টি চা বাগানে কর্ম বিরতি পালন হয়। শ্রীমঙ্গলের বালিশিরা ভ্যালির ৫৮টি চা বাগানের মাঝে ৪৮টি চা বাগানে ও সাতগাঁও এলাকায় ৬টি চা বাগানের মাঝে ৪টি চা বাগানে কর্ম বিরতি পালন হয়। তার আগে কর্মবিরতির সমর্থনে গত সোমবার সন্ধ্যার পর সবগুলো চা বাগানে মশাল মিছিল হয়। চা শ্রমিক ইউনিয়ন সূত্রে দাবী করা হয় দেশের ৮০ শতাংশ চা বাগানে শান্তিপূর্ণভাবে চা শ্রমিকরা কর্ম বিরতি পালন করে। এ কর্মসূচী বুধবারও পালন করবে চা শ্রমিকরা।
কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক জি, এস ধর (মোবাইল: ০১৭১১-৩৫৪৩৭৫) জানান, তিনি চট্রগ্রামের একটি প্রাইভেট হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকায় কথা বলতে পারবেন না। তবে মালিক পক্ষের প্রতিনিধি মনু-ধলই ভ্যালি (অঞ্চল)-র সভাপতি পাত্রখোলা চা বাগান ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ শামসছুল ইসলাম চা শ্রমিকদের একযোগে কর্মবিরতি পালনের সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, আন্দোলনরত চা শ্রমিকরা আগে থেকেই এ আন্দোলনের কথা মালিক পক্ষকে জানিয়েছে। তিনি আরও বলেন, এক যোগে দুই শতাধিক চা বাগানে কোন কাজ না হলে কাঁচা পাতা উত্তোলন, জমা কাঁচা পাতা বিনষ্টসহ চা শিল্পে বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যাবে।
জানা যায়, ২০১২ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মৌলভীবাজারে এক জনসভায় চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি কমপক্ষে একশ’টাকা ঘোষণাসহ বিভিন্ন দাবি বাস্তবায়নের আশ্বাস দেন। এরপর শ্রমিকরা ২০ দফা দাবিতে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ঢাকায় একবার দেখাও করেন। সেসময়ও তিনি দাবি বাস্তবায়নের আশ্বাস দেন। কিন্তু দীর্ঘদিন পেরিয়ে গেলেও দাবিগুলো বাস্তবায়িত হয়নি। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে বাগান মালিকরা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ৫৫ টাকার বদলে ৬২ টাকা করেন। সাত টাকা করে প্রহসনের মজুরি বৃদ্ধির বিষয়টি শ্রমিকরা মেনে নেননি। মঙ্গলবার বেলা ১১টা পর্যন্ত ধর্মঘট প্রত্যাহারের বিষয়ে বাগান মালিক বা সরকারের পক্ষ থেকে কেউ তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি বলেও জানান ।