‘রাজাকার সাখাওয়াত মোচড় দিয়ে আমার বাম পা ভেঙ্গে দেয়’
নিউজ ডেস্ক :: একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জাতীয় পার্টির নেতা ও যশোর-৬ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মাওলানা সাখাওয়াত হোসেনসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের ৬ষ্ঠ সাক্ষি যশোর জেলার কেশবপুর থানার মহাদেবপুর গ্রামের মিরন শেখ তার সাক্ষ্য প্রদান করেছেন।
এ মামলায় সাখাওয়াত হোসেন ছাড়া অন্য আসামীরা হলেন- মো. বিল্লাল হোসেন, মো. ইব্রাহিম হোসেন, শেখ মোহাম্মদ মুজিবর রহমান, মো. আব্দুল আজিজ সরদার, মো. আজিজ সরদার, কাজী ওয়াহেদুল ইসলাম, মো. লুৎফর মোড়ল এবং মো. আব্দুল খালেক মোড়ল। আসামিদের মধ্যে গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আছেন সাখাওয়াত হোসেন, মো. বিল্লাল হোসেন ও মো. লুৎফর মোড়ল।
বুধবার ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. আনোয়ারুল হকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সাক্ষি তার জবানবন্দি দেন।
এসময় সাক্ষির জবানবন্দি গ্রহণে তাকে সাহায্য করে প্রসিকিউটর সুলতানা রেজিয়া এবং প্রসিকিউটর সুলতান মাহমুদ সীমন ।
জবানবন্দিতে সাক্ষি মিরন শেখ বলেন, ‘১৯৭১ সালে আমাদের গ্রামে মুক্তিবাহিনী গঠিত হলে আমি মুক্তিবাহিনীতে যোগদান করি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে আমি আমার স্ত্রী ও ভাই-বোনদের দেখতে আমার গ্রামের বাড়িতে আসি। আমার আসার খবর পেয়ে পার্শবর্তী চিংড়া রাজাকার
ক্যাম্পের ৩০/৪০জন রাজাকার আমাদের গ্রাম ঘেরাও করে এবং মুক্তিযুদ্ধ ও আওয়ামী লীগের সমর্থকদের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে’।
তিনি আরো বলেন, ‘এরপর ১০/১২জন রাজাকার আমাদের বাড়ি ঘেরাও করলে আমি দৌড়াতে থাকি এবং এক পর্যায়ে মাঠের মাঝখানে হাত উঁচু করে দাড়িয়ে যাই। এই মামলার আসামী আব্দুল খালেক আমাকে হত্যা করার জন্য আমাকে লক্ষ্য করে রাইফেল দিয়ে গুলি করলে আমার বাম হাতে গুলি লাগে এবং আমার বাম হাতের দুটি আঙ্গুল আঘাতে ঝুলে পড়ে। এরপর আমাকে রাজাকার ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যাবার পর আসামী সাখাওয়াতের নির্দেশে আমাকে পিটাতে থাকলে আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি’।
সাক্ষি মিরন শেখ বলেন, রাতে জ্ঞান ফিরলে রাজাকার সাখাওয়াত আমার কাছে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প সম্পর্কে তথ্য চায়। আমি তথ্য না দিতে চাওয়ায় রাজাকার সাখাওয়াত মোচড় দিয়ে আমার বাম পা ভেঙ্গে দেয় এবং তখন আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাই। পরের দিন জ্ঞান ফিরলে আমি কপোতাক্ষ নদের দক্ষিণ পাড়ে পড়ে আছি দেখতে পাই। আমার কান্নাকাটির শব্দ শুনে গ্রামের লোকজন গরুর গাড়ীতে করে আমাকে ভারতের টাকি হাসপাতালে ভর্তি করায়। তখন ডাক্তার আমার অপারেশন করে আমার দুইটি আঙ্গুল কেঠে ফেলে দেয়। পরে আমি দেশে ফিরে এসে দেখতে পাই, রাজাকাররা আমার বাড়ি-ঘর ধ্বংস করে দিয়েছে।
পরে সাক্ষির জবানবন্দি গ্রহণ শেষ হলে তাকে আসামীপক্ষের আইনজীবী আব্দুস শুক্কুর খান এবং আইনজীবী আব্দুস সাত্তার পালোয়ান জেরা করেন।
জেরা শেষ হলে ট্রাইব্যুনাল মামলার পরবর্তি সাক্ষির জন্য আগামীকাল বৃহস্পতিবার মামলার পরবর্তি দিন নির্ধারনের আদেশ দেন।
উল্লেখ্য, এর আগে গত ৮ সেপ্টেম্বর তাদের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল। মোট ১২ আসামীর মধ্যে বাকি তিনজনের সম্পৃক্ততা না পাওয়ায় তাদেরকে অব্যাহতি দিয়েছেন।
গত ১৬ জুন সাখাওয়াতসহ আসামীদের বিরুদ্ধে তদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেন। এর আগে আদালত ৮ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে আত্মসমর্পণের জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ দেন।
২০১২ সালের ১ এপ্রিল থেকে এ মামলায় তদন্ত শুরু করে গত ১৪ জুন শেষ করেছেন তদন্তকারী কর্মকর্তা আবদুর রাজ্জাক খান। মুক্তিযোদ্ধাসহ ৩২ জনকে এ মামলার সাক্ষী করা হয়েছে।
১৯৯১ সালে জামায়াতের পক্ষে নির্বাচনে দাঁড়িয়ে যশোর-৬ আসন থেকে শাখাওয়াত সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। কিন্তু মেয়াদপূর্তির আগেই জামায়াত ছেড়ে বিএনপিতে যোগ দেন। মাওলানা সাখাওয়াত গত সংসদ নির্বাচনে যশোর-৬ আসন থেকে তিনি জাতীয় পার্টি থেকে মনোনয়ন পেয়েছিলেন।
আসামীদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ ৫টি হলো:
অভিযোগ ১: যশোরের কেশবপুর উপজেলার বোগা গ্রামে এক নারীকে অপহরণ, আটক, নির্যাতন এবং ধর্ষণ।
অভিযোগ ২: একই উপজেলার চিংড়া গ্রামের চাঁদতুল্য গাজী ও তার ছেলে আতিয়ারকে অপহরণ, আটক, নির্যাতন ও হত্যা।
অভিযোগ ৩: কেশবপুরের চিংড়া গ্রামের মো. নুরুদ্দিন মোড়লকে অপহরণ, আটক, নির্যাতন।
অভিযোগ ৪: কেশবপুরের হিজলডাঙার আ. মালেক সরদারকে অপহরণ, আটক, নির্যাতন ও খুন।
অভিযোগ ৫: কেশবপুরের মহাদেবপুর গ্রামের মিরন শেখকে অপহরণ, আটক, নির্যাতন এবং ওই গ্রামে অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠন।