দুই ইউনিয়নে নির্বাচন নেই ১৩ বছর!
নিউজ ডেস্ক :: শরীয়তপুরের গোসাইরহাট উপজেলার দূর্গম চরাঞ্চলের দুইটি ইউনিয়নে নির্বাচন হয়না গত ১৩ বছর যাবৎ। সীমানা সংক্রান্ত জটিলতা দেখিয়ে উচ্চ আদালতে মামলা করে যুগের পর যুগ ক্ষমতায় থাকার জন্য নির্বাচন হতে না দেয়ার অভিযোগ উঠেছে চেয়ারম্যানদের বিরুদ্ধে।
ক্ষমতাসীন চেয়ারম্যানদের কূটকৌশলের কারণে এ বছরও নির্বাচন না হওয়ার তালিকায় পড়েছে ওই ইউনিয়ন দুটি। আর নির্বাচনের দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠেছে এলাকার হাজার হাজার লোক।
দেশের সর্বত্রই এখন বইছে নির্বাচনের বাতাস। উৎসাহ আর বিপুল উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে কোন না কোন অঞ্চলে প্রস্তুতি চলছে স্থানীয় সরকার কাঠামোর সবচাইতে শক্তিশালী ও তৃণমূলের মানুষের প্রিয় ঠিকানা ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের। কিন্তু ব্যত্যয় ঘটেছে শরীয়তপুর জেলার আলাওলপুর ও কুচাইপট্টি ইউনিয়নে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ২০০৩ সালে সর্বশেষ নির্বাচন হয় এই দুটি ইউনিয়নে। এরপর প্রায় ৯ বছর পর ২০১১ সনের ১২ জুন নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে ওই বছর ২৬ এপ্রিল সারা দেশের সাথে ওই ইউনিয়ন দুটিতেও নির্বাচন করার জন্য তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। তফসিল ঘোষণার এক সপ্তাহ পর ৩ মে, ২০১১ তারিখে চাঁদপুর জেলার হাইমচর উপজেলার হাইমচর ইউনিয়ন ও নীলকোমল ইউনিয়নের সাথে সীমানা জটিলতা দেখিয়ে আলাওলপুর ইউপি চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেন বেপারী এবং কুচাইপট্টি ইউপি চেয়ারম্যান আবুল বাশার মুন্সি বাদী হয়ে উচ্চ আদালতে রীট পিটিশন দায়ের করেন। তাদের দায়েরকৃত মামলার প্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত ৩ মাসের জন্য উল্লেখিত দুটি ইউনিয়নের নির্বাচন স্থগিতের আদেশ প্রদান করেন। উচ্চ আদালতের আদেশে নির্বাচন কমিশন নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগের দিন অর্থাৎ ১১ জুন ২০১১ তারিখে ভোট গ্রহণের কয়েক ঘণ্টা আগে নির্বাচন স্থগিত করে পত্র প্রেরণ করেন।
এরপর আলাওলপুরের ওসমান বেপারী ও কুচাইপট্টির মাহবুব সোহেল নামের দুই ব্যক্তি ২০১৩ সালের ২৮ জানুয়ারি ইউনিয়ন দুটিতে নির্বাচনের তফসিল পূনরায় ঘোষণার জন্য আপিল করেন। তাদের আপিলের ভিত্তিতে উল্লেখিত ইউনিয়নে কেন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবেনা মর্মে উচ্চ আদালত ৪ সপ্তাহের রুল জারি করেন। কিন্তু এ মামলার নিষ্পত্তি না হওয়ায় এ বছরও নির্বাচন না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন। ফলে এলাকার হাজার মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে নির্বাচন করার দাবিতে।
শরীয়তপুর জেলা নির্বাচন কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ইতিমধ্যেই সরকার দেশের সবগুলো মেয়াদ উত্তীর্ণ ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনের জন্য তফসিল ঘোষণা করেছেন। ২২ মার্চ থেকে পর্যায়ক্রমে ৬টি ধাপে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সম্ভাব্য দিনক্ষনও নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে শরীয়তপুরের ৬ উপজেলার ইউনিয়ন গুলোতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ৩য়, ৫ম ও ৬ষ্ঠ ধাপে। তৃতীয় ধাপেই ২৩ এপ্রিল নির্বাচন হওয়ার কথা গোসাইরহাটের ৮টি ইউনিয়নে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন থেকে প্রেরিত তালিকায় বাদ পরেছে গোসাইরহাটের আলাওলপুর, কুচাইপট্টি ও ইদিলপুর ইউনিয়ন।
এলাকাবসী জানিয়েছেন, চাঁদপুর জেলার হাইমচর ও নীলকোমল ইউনিয়ন দুটির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে যথা সময়ে। তারা কোন সীমানা জটিলতার প্রশ্ন তুলছেনা। অথচ দুই চেয়ারম্যান সীমাহীন দুর্নীতির কারণে জনপ্রিয়তা হারিয়ে পরবর্তীতে বিজয়ী হতে না পারার ভয়ে মামলা দিয়ে দীর্ঘ দিন নির্বাচন আটকে রেখেছে।
এলাকার লোক আরো অভিযোগ করেছে চলতি তফসিলেও যাতে অনুষ্ঠিত হতে না পারে সে জন্য তারা আগে থেকেই নির্বাচন কমিশনে যোগাযোগ করে নির্বাচন বন্ধ রেখেছে।
উল্লেখ্য যে, স্বাধীনতার পর থেকেই গোসাইরহাট উপজেলায় ৭টি ইউনিয়ন ছিল। ইউনিয়নগুলো হলো গোসাইরহাট, ইদিলপুর, নলমুড়ি, সামন্তসার, নাগের পাড়া, কোদালপুর ও গরীবের চর। ২০০৯ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর গরীবেরচর ইউনিয়নের নাম পরিবর্তন করা হয়। গরীবেরচরে মধ্যযুগীয় কবি আলাওলের জন্মস্থান হওয়ায় তার নামানুসারে গরীবের চরের নতুন নামকরণ করা হয় আলাওলপুর ইউনিয়ন নামে ।
অপরদিকে গোসাইরহাটের দক্ষিণ সীমায় অবস্থিত বরিশালের সর্ব উত্তরের হিজলা উপজেলার কুচাইপট্টি ইউনিয়নটি প্রশাসনিক ও ব্যবসা বাণিজ্যসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে গোসাইরহাট বা শরীয়তপুরে সুবিধাজনক হওয়ায় ওই ইউনিয়নের সকল মানুষের দাবির প্রেক্ষিতে ২০০৫ সালের ২৮ ডিসেম্বর ১৯টি মৌজা সমেত শরীয়তপুর জেলার গোসাইরহাট উপজেলার সাথে সংযুক্তি হয়। ফলে ৭ ইউনিয়ন থেকে ৮টি ইউনিয়নে রূপান্তরিত হয় গোসাইরহাট উপজেলা।
আলাওলপুর ও কুচাইপট্টি ইউনিনের বাসিন্দা শহিদ উদ্দিন খান, আব্দুল খালেক মাদবর, শাহজাহান মাল, সবুজ সরদার, মানিক মিয়া, খারশেদ আলম, সামাদ খান ও খোকন বেপারী বলেন, আমাদের ইউনিয়নের সাথে যদি চাঁদপুরের কোন দ্বন্দ্ব থাকতো তাহলে তো সেখানে নির্বাচন হতো না। হাইমচর ইউনিয়ন ও নীলকোমল ইউনিয়নের নির্বাচন সেখানে প্রথম ধাপেই হচ্ছে। অথচ আমাদের দুর্নীতিগ্রস্ত চেয়ারম্যানেরা ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য অহেতুক মামলা করে জনগণকে তাদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করছে। আমরা দ্রুত সময়ের মধ্যে আমাদের ইউনিয়নে নির্বাচন চাই।
কুচাইপট্টি ইউনিয়নের বাসিন্দা ও শরীয়তপুর জেলা যুবলীগের সহ-সভাপতি নাসির উদ্দিন স্বপন বলেন, ২০১১ সালে আমি কুচাইপট্টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামীলীগ মনোনীত প্রার্থী ছিলাম। নির্বাচনের জন্য আমাদের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করাও হয়েছিল। বর্তমান চেয়ারম্যানের সীমানা জটিলতা সংক্রান্ত একটি মামলার কারণে ১১ জুন ঠিক নির্বাচনের আগের দিন কমিশন নির্বাচন বন্ধ করে দেন। অথচ ২০০৭ সালে যথাযথ নিয়ম অনুসারে আন্ত:জেলা সীমানা নিষ্পত্তি করা হয়। সে সময় ডিসি শরীয়তপুর ও ডিসি চাঁদপুরের প্রতিনিধির উপস্থিতিতে সীমানা পিলার স্থাপন করা হয়। সে পিলার স্থাপনের পরেও কিভাবে ২০১১ সালের নির্বাচনী তফসিলের পর নির্বাচন বন্ধ করা হয় এটা আমাদের বোধগম্য নয়।
আলাওলপুর ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি নজরুল ইসলাম সরদার ও কুচাপট্টি ইউনিয়ন আ’লীগের সভাপতি মোশারফ হোসেন গাজী বলেন, একটি অহেতুক মামলাকে পুঁজি করে বর্তমান দুই চেয়ারম্যান যুগের পর যুগ ক্ষমতায় থেকে যাচ্ছে। কোনো গণতান্ত্রিক দেশে এভাবে নির্বাচন আটকে রাখার নজির নেই। এভাবে চলতে দেয়া যায়না।
তারা আরো বলেন, যাতে এই দুইটি ইউনিয়নের নির্বাচন এবছর অনুষ্ঠিত হয় এ জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কাছে আমরা জোর অনুরোধ জানাই। তা না হলে দেশের দেশের নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উপর জনগণের আস্থাহীনতা সৃষ্টি হবে।
পার্শ্ববর্তি কোদালপুর ইউপি চেয়ারম্যান মো. মিজানুর রহমান সরদার বলেন, কুচাইপট্টি ও আলাওলপুর ইউনিয়নের মাঝ খানে আমার ইউনিয়ন। ওই দুইটি ইউনিয়নের সাথে সীমানা জটিলতা থাকলে আমার ইউনিয়নের সাথেও তো জটিলতা থাকার কথা। কই, আমি তো কোন মামলা মোকদ্দমা করিনি? আমার জানা মতে যে দুটি চর নিয়ে মামলা করা হয়েছে সেখানকার বাসিন্দারা শান্তিপূর্ণ ভাবেই বসবাস করছে। কারো হীন-স্বার্থকে চরিতার্থ করার অভিপ্রায়ে এ মামলা করে নির্বাচন আটকে রাখা হচ্ছে বলে আমি ধারণা করছি।
মামলার বাদী আলাওলপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেন বেপারী বলেন, সীমানা সংক্রান্ত জটিলতার মামলা শেষ হলেই নির্বাচন করতে হবে। তা না হলে আমাদের হাজার হাজার একর জমি হাতছাড়া হয়ে যাবে। গত ৫ বছরেও এই মামলা নিষ্পত্তি করে জমি বুঝে নিতে পারলেন না কেন এমন প্রশ্নের জবাবে আমজাদ বেপারী বলেন, আমি প্রতিটি সভাতেই সরকারের প্রতিনিধিদের কাছে এ বিষয়ে দাবি রেখে আসছিলাম। এখন সরকার আন্তরিক না হলে আমার কি করার আছে।
শরীয়তপুর জেলা নির্বাচন অফিসার সেক মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন বলেন, গোসাইরহাট উপজেলার ৮টি ইউনিয়নের মধ্যে ৫টি ইউনিয়নের নির্বাচন সম্পন্ন করার জন্য আমার কাছে নির্দেশনা এসেছে। তৃতীয় ধাপে এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। উল্লেখিত দুইটি ইউনিয়নের নির্বাচন করার জন্যও আমাদের সকল ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে। তবে মামলা সংক্রান্ত জটিলতা মীমাংসা হওয়ার পর কমিশন থেকে নির্দেশনা পেলেই আমরা নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করবো।