নতুন সংকটে বিএনপি
নিউজ ডেস্ক: আন্দোলন কিংবা দলকে গতিশীল করার কোনো ছক ও কার্যক্রম নেই বিএনপির। দলটির নেতারা বলছেন, দল গোছানোর কাজে হাত দিয়ে প্রায় আড়াই বছর কেটে গেছে। সর্বশেষ দলের জাতীয় সম্মেলনের পর তিন মাস হলো, পূর্ণাঙ্গ কমিটি করা যায়নি; বরং সম্মেলনের পর কমিটি নিয়ে নেতাদের মধ্যে দলাদলি আরও বেড়েছে। ফলে এখন আর আন্দোলনের বিষয়টি দলের নীতিনির্ধারকদের চিন্তাতেই নেই।
এ বিষয়ে গত এক সপ্তাহে বিএনপির স্থায়ী কমিটি, ভাইস চেয়ারম্যান ও যুগ্ম মহাসচিব পদের সাতজন নেতার সঙ্গে কথা হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁরা বলেন, এখন দলের সব পর্যায়ে স্থবিরতা বিরাজ করছে। ১৯ মার্চ দলের ষষ্ঠ জাতীয় সম্মেলনের পর তিন মাসেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা না করায় জ্যেষ্ঠ ও মধ্যম সারির নেতাদের বড় একটি অংশ ক্ষুব্ধ ও বিরক্ত। প্রথম দেড় মাসে তিন দফায় ৪২টি পদে নাম ঘোষণা করা হয়। দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্ষদ স্থায়ী কমিটি ও গুরুত্বপূর্ণ সম্পাদকীয় পদগুলোর বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এসব পদ পেতে আগ্রহী নেতাদের মধ্যে চলছে স্নায়ুযুদ্ধ। কোন্দলও বাড়ছে। ভেতরে ভেতরে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের বেশির ভাগ নেতা বিভক্ত হয়ে আছেন।
দলের জ্যেষ্ঠ ও গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের অনেকে অভিমান করে নিজেদের গুটিয়ে রেখেছেন। এমন একাধিক নেতা বলেন, দলীয় প্রধান খালেদা জিয়া তাঁদের কোনো পরামর্শ নিচ্ছেন না, আবার যেচে কিছু বললেও ফলাফল শূন্য। খালেদা জিয়ার এড়িয়ে চলা মনোভাবে জ্যেষ্ঠ নেতাদের মধ্যেও হতাশা ভর করছে। হতাশা ছড়িয়েছে মাঠপর্যায়েও। পরিস্থিতি এমন যে, আন্দোলন-কর্মসূচির চিন্তাও যেন ‘পরিত্যক্ত’ হয়ে গেছে।
দলের স্থায়ী কমিটির একজন প্রবীণ সদস্য বলেন, ‘এত দিনেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি না দেওয়ায় আমরা কমিটি নিয়ে দলাদলি করছি। আন্দোলন নিয়ে চিন্তা করার সময় কই।’ তিনি বলেন, গত দুই-আড়াই মাসে বিএনপির যত নেতা দলের চেয়ারপারসনের সঙ্গে দেখা করেছেন, তাঁরা হয় নিজের ব্যক্তিগত, নাহয় কমিটি নিয়ে কথা বলেছেন। একজনও আন্দোলন-কর্মসূচি নিয়ে কথা বলেছেন, এমনটি তাঁর জানা নেই।
দলের স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য বলেন, রাজনীতিকদের সম্মানে ১১ জুন বিএনপির চেয়ারপারসন যে ইফতার অনুষ্ঠানের আয়োজন করে, তাতেও জ্যেষ্ঠ নেতাদের সম্পৃক্ত করা হয়নি। এর দায়িত্বে ছিলেন খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ের কর্মকর্তারা। ফলে ২০-দলীয় জোটের বাইরের কোনো রাজনীতিককে ইফতারে আনা যায়নি। উল্টো ইফতারে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদের সাবেক স্ত্রী বিদিশার উপস্থিতি নিয়ে কথা উঠেছে। কোন বিবেচনায়, কার উৎসাহে তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতা।
বিএনপির উচ্চপর্যায় ও মধ্যম সারির গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কবে নাগাদ পূর্ণাঙ্গ কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করা হবে, কবে নাগাদ বিএনপি আন্দোলনে যাবে কিংবা দলের ভবিষ্যৎ কর্মকৌশল কী হবে—এসব বিষয়ে নেতাদের কারও সুস্পষ্ট ধারণা নেই। বিষয়গুলো নিয়ে তাঁরা দলের চেয়ারপারসনের কাছ থেকে কোনো বার্তাও পাচ্ছেন না। বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য বলেন, ‘দেখি না, ম্যাডাম (চেয়ারপারসন) আমাদের বাদ দিয়ে কত দূর যেতে পারেন।’
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ‘একতরফা’ সংসদ নির্বাচন ঠেকাতে ব্যর্থ আন্দোলনের পর ফেব্রুয়ারিতে দল গোছানোর ঘোষণা দেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। তা শেষ না করেই ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে আবার সরকার পতনের আন্দোলনে নামে বিএনপি। টানা তিন মাস রাজপথের আন্দোলনে থাকলেও বিএনপির লক্ষ্য অর্জিত হয়নি। এরপর আবার দল পুনর্গঠনের কথা বলেছিলেন দলীয় প্রধান খালেদা জিয়া। তা-ও সফল হয়নি।
কেবল ছাত্রদল ও শ্রমিক দলের কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে ছাত্রদলে কমিটি নিয়ে বিদ্রোহ হয়। আর শ্রমিক দলের বিক্ষুব্ধ একাংশ শ্রম আদালতের শরণাপন্ন হয়েছে। বাকি নয়টি অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের কোনোটিই পুনর্গঠন করা যায়নি। গত বছরের আগস্টে ৭৫টি সাংগঠনিক জেলা কমিটি পুনর্গঠনের উদ্যোগ নিয়ে গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মাত্র ১৪টি জেলায় সম্মেলন বা নতুন কমিটি করা গেছে। কমিটি পুনর্গঠন নিয়ে মাঠপর্যায়ে ঝগড়া-বিবাদ আরও বেড়েছে। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে খারাপ ফলের পেছনে ক্ষমতাসীনদের জোরজবরদস্তির পাশাপাশি দলের স্থানীয় কোন্দলও কাজ করেছে বলে মনে করেন কোনো কোনো নেতা।
অবশ্য দল গোছানোর বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলামের মত হচ্ছে, দল সংগঠিত করার মতো পরিবেশ বিএনপি পায়নি। তিনি বলেন, সরকার নেতা-কর্মীদের ওপর যে পরিমাণে অত্যাচার-নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে, গুম, খুন করছে; ইচ্ছা থাকলেও দল সংগঠিত করা যাচ্ছে না। যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ, জঙ্গিবিরোধী অভিযানের নামে বিএনপির নেতা-কর্মীসহ নিরীহ মানুষদের গণহারে গ্রেপ্তার করা।
দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক সূত্র বলেছে, তারা আশঙ্কা করছে, দুর্নীতির মামলায় খালেদা জিয়াকে সাজা দিয়ে দেওয়া হতে পারে। এরপর দলের একটি অংশকে হাত করে সরকার তার মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগে নির্বাচন দিতে পারে—এমন কথাও শুনছেন তাঁরা।
খালেদা জিয়া নিজেও ৯ জুন জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের ইফতারে এমন আশঙ্কার ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ যদি বিএনপির নেতা-কর্মীদের মামলা দিয়ে, সাজা দিয়ে নির্বাচন করতে চায়, তা সহজ হবে না। সেই নির্বাচন দেশে-বিদেশে কারও কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না।
বিএনপির শীর্ষস্থানীয় তিনজন নেতা বলেন, খালেদা জিয়া কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতার ওপর পুরোপুরি আস্থা রাখতে পারছেন না। নানা গুঞ্জন ও লেখালেখির কারণে তাঁরা সন্দেহের চোখে আছেন। কিন্তু দলের নেতাদের মূল্যায়ন হচ্ছে, সামনে আরও কঠিন সময় আসছে। এই অবস্থায় প্রবীণ নেতাদের কমিটিতে রাখা না হলে বা গুরুত্বপূর্ণ পদ দেওয়া না হলে এর প্রতিক্রিয়া আরও খারাপ হতে পারে।
বিষয়টি দলীয় চেয়ারপারসনের জন্য ‘উভয়সংকট’ অবস্থা তৈরি করেছে। এ কারণে পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করতে সময় নেওয়া হচ্ছে।
দলীয় সূত্রগুলো বলছে, দীর্ঘদিন মামলা-হামলায় আত্মগোপনে থাকা নেতা-কর্মীদের বড় অংশ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন উপলক্ষে প্রকাশ্যে এসেছিল। এ ছাড়া ৩০ মে দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকী এবং রমজান মাসে রাজধানীসহ সারা দেশে ইফতার অনুষ্ঠানকে ঘিরে নেতা-কর্মীরা কিছুটা সংগঠিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। ৪ জুন বিএনপির সাংগঠনিক ও সহসাংগঠনিক সম্পাদকদের বৈঠকে ইউপি নির্বাচন ঘিরে সক্রিয় হওয়া নেতা-কর্মীদের চাঙা ভাব ধরে রাখার উপায় নিয়ে আলোচনা হয়েছিল।
কিন্তু জঙ্গিবিরোধী পুলিশের ‘সাঁড়াশি অভিযান’ নেতা-কর্মীদের সেই চাঙা ভাব মিইয়ে দিয়েছে। গত শনিবার সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী দাবি করেন, এবারের বিশেষ অভিযানে সারা দেশে বিএনপির ২ হাজার ৭০০ জন নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
বিএনপি সমর্থক বুদ্ধিজীবীদের সংগঠন শত নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, ‘সরকার তো তাদের শান্তিতে থাকতে দিচ্ছে না। খাড়া হওয়ার সুযোগই দিচ্ছে না। সরকারের জোরজবরদস্তি, গ্রেপ্তার—এসব কারণে তারা সংগঠিত হওয়ার পরিবেশ পাচ্ছে না।’ কমিটি ঘোষণায় সরকারের বাধা আছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘তা নেই। আমি যতটুকু জানি, খালেদা জিয়া শারীরিকভাবে পুরোপুরি সুস্থ নন। আশা করি, খুব অল্প সময়ের মধ্যে কমিটি ঘোষণা করা হবে।’
এ পরিস্থিতিতে বিএনপির আবার ঘুরে দাঁড়ানো বা আন্দোলন কর্মসূচিতে যাওয়ার মতো সাংগঠনিক অবস্থা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে সংশয় আছে। সাংগঠনিক এমন আগোছালো অবস্থায় যদিও দলটি নির্বাচন ও সরকার পরিবর্তনের আশা করছে। এ ক্ষেত্রে তারা এখনো বিদেশিদের দিকেই তাকিয়ে আছে। নেতারা মনে করছেন, বহির্বিশ্বের চাপে সরকার সবার অংশগ্রহণে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন দিতে বাধ্য হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘আমরা গণতন্ত্রকে উদ্ধারের জন্য আন্দোলন করছি। হয়তো অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারিনি। আমাদের বিরুদ্ধে বাইরের শত্রু কাজ করছে। অর্থাৎ সরকারের মারমুখী অবস্থানে নেতা-কর্মীরা ক্ষতিগ্রস্ত। আবার আমাদের নিজেদেরও ঘাটতি আছে। এত সুন্দর একটি কাউন্সিল হলো, কিন্তু এর ফসল ঘরে তুলতে পারিনি। দলকে গোছাতে পারিনি।’ -প্রথম আলো।