নবীগঞ্জে তন্নী হত্যা: খুনিরা কি পুলিশের নেটওয়ার্কের বাহিরে?
নবীগঞ্জে ‘তন্নী রায়’ নামটা এতো দিন অচেনা থাকলেও, তার লাশ পাওয়ার পর নবীগঞ্জ উপজেলা তথা হবিগঞ্জের সবর্ত্র পরিচিত হয়ে উঠেছে। এখন সবার মুখে মুখে একটাই উচ্চারন, ‘তন্নী হত্যার বিচার চাই’। তন্নী নবীগঞ্জ ডিগ্রী কলেজের মেধাবী ছাত্রী সে চলতি বছর কৃতিত্বের সাথে এইচএসসি পাশ করে। মা-বাবা’র খুব আদরের মেয়ে এবং ভাই’র একমাত্র বোন। তন্নীকে নিয়ে অনেক আশা ছিল পরিবারের লোকজনের। দু’ভাই বোনের মধ্যে তন্নী রায় ছোট। কিন্তু কেই বা জানতো ফুল ফোটার আগেই যে কলি ঝরে যাবে। এদিকে তন্নী নিখোঁজের আজ ৯ দিন এবং লাশ উদ্ধারের ৬ দিন অতিবাহিত হয়ে গেল। কিন্তু তন্নীর হত্যাকারীরা গ্রেফতার হচ্ছেনা কেন..? অপরাধীরা কি পুলিশের নেটওয়ার্কের বাহিরে, নাকি অপরাধীদের নেটওর্য়াক পুলিশের নেটওর্য়াকের চেয়েও গতিশীল, এমন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে জনমনে। কিনারা লাগতে আর কত দিন ও পুলিশের ভুমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেছেন সচেতন নাগরিকরা। গতকাল একটি সংঘঠনের আয়োজনে অনুষ্ঠিত মানববন্ধন ও পথ সভায় বক্তারা বক্তৃতাকালে পুলিশ ভূমিকা ও লাশ উদ্ধারের পর রহস্য উদঘাটনে কত দূর এগোচ্ছে এনিয়ে নানা বক্তব্য দেন এবং কঠোর আন্দোলনে নামার হুশিয়ারিও দেন।
এদিকে, রানু ও তার পরিবার দেশে না সীমান্ত পাড়ী দিয়ে ভারতে চেলে গেলে এনিয়েও চলছে নানা আলোচনা। এক দিকে যেমন জনমনে দেখা দিয়েছে চাপা ক্ষোভ অন্য দিকে নিহতের পরিবারে চলছে মাতম। তারাও রয়েছেন চরম হতাশায়। অন্য দিকে এ ঘটনায় আতংকের মধ্যে শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা। কারন নবীগঞ্জের ইতিহাসে এমন নির্মম ঘটনা বিরল। নবীগঞ্জ উপজেলার সর্বত্র গত ক‘দিন ধরে শুধূ তন্নী হত্যা নিয়েই চলছে আলোচনা, সমালোচনা। এমনকি বিশ্লেষকরা এনিয়ে করছেন চুল ছেড়া বিশ্লেষন। এ ঘটনার পর আলোচনায় আসছে পূর্বের ঘটনাগুলোর কথা। তার কি সঠিক বিচার হয়েছিল, নাকি বিচারের বাণী নিরবে নিবৃতে এখনও কাদছে। পিছন ফিরে দেখলে ২০১৪ সালে নবীগঞ্জের একটি আলোচিত ঘটনা ছিল অঞ্জনা হত্যা। নবীগঞ্জের সচেতন নাগরিক সমাজ খেয়ে না খেয়ে আন্দোলনে মাঠে ছিল সরব। শেষ পর্যন্ত কি হলো..? ছয় নয় অতঃপর কিচ্ছা খতম। মামলা শেষ।
তন্নীর গুপ্ত হত্যা জানান দেয়- দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত খুন খারাবির মতো নবীগঞ্জ শহরও কি সেই দিকে পা বাড়াচ্ছে। শান্তি প্রিয় নবীগঞ্জবাসী এই অবস্থা কখনও মেনে নিবে না। প্রয়োজনে দলমতের উর্ধে উঠে নবীগঞ্জবাসী জেগে উঠবে। শোককে পাথরে পরিনত করে রাস্তায় রাস্তায় প্রতিবাদে আলোর মিছিল হবে বলে জানিয়েছেন। তবুও তন্নী রায়ের মতো আর কোন মেয়ে বা শিক্ষার্থীকে এভাবে প্রাণ হানির ঘটনা ঘটতে দেয়া হবে না। তন্নীর পিতা বিমল রায়’র বাড়ি উপজেলার করগাওঁ ইউনিয়নের পাঞ্জারাই গ্রামে। ব্যবসা করার সুবাধে দীর্ঘদিন ধরে নবীগঞ্জ শহরে বসবাস। এক খন্ড ভূমি কিনে ঘর নির্মাণ করে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন পৌর শহরের শ্যামলী (ধান সিড়ি) আবাসিক এলাকায়। বিমল রায় বর্তমানে ইভা ফার্নিচার এর ম্যানাজার হিসেবে কর্মরত। তন্নীর বাবা বিমল রায়ের বাসার এক রুমে ভাড়া থাকতেন কানু রায়। উক্ত কানু রায়ের মুল বাড়ি বানিয়াচং উপজেলার পুকড়া গ্রামে। তিনি শহরে সবজি ব্যবসা করেন। ওই বাসায় ভাড়া নেয়ার আগে উপজেলার আদিত্যপুর, দত্তগ্রাম এবং শহরের ডাক বাংলো সড়কে ভাড়ায় বসবাস করতেন। পরে বিমল রায়ের বাসায় ভাড়াটে হিসেবে জায়গা নেন। প্রায় মাস দেড়েক আগে জয়নগর এলাকায় নতুন বাড়িতে গিয়ে উঠেন কানু রায়। উক্ত কানু রায়ের ছেলে রানু রায়। তন্নীর বাবা বিমল রায়ের বাসায় ভাড়া থাকার সুবাধেই তন্নী ও রানুর মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে। প্রেম প্রেম খেলার বলি হবে তন্নী কেউ ভাবতেও পারেনি। প্রেমিক রানু রায়ের একটি টেলিফোনে ঘর থেকে ১৭ সেপ্টেম্বর দুপুর ১.৩০ ঘটিকায় তন্নী রায় বেড় হয়ে বাসায় না ফেরায় পরিবারে নেমে আসে প্রচন্ড ঝড়। সেই ঝড়ে হারিয়ে গেল মেধাবী ছাত্রী তন্নীর প্রাণ। কিন্তু এই ঝড় মেনে নেওয়ার মতো না। যে দিন তন্নী রায়ের মৃতদেহ বস্তাবন্দি অবস্থায় উদ্ধার করে পুলিশ, সে দিন নীরব, নিঃস্তব্ধ লাগে নবীগঞ্জ শহর। যেন অচেনা একটি শহরে পরিনত হয়। কারন ওই দিন তন্নী রায় নামের এক মেধাবী ছাত্রীর বিকৃত ও পচন ধরা বস্তাবন্দি অবস্তায় লাশ পাওয়া যায়। বাড়ি থেকে নিখোঁজ হওয়ার ৩ দিনের মাথায় নদীতে ভেসে উঠে তন্নী’র বস্তাবন্দি লাশ। এ ঘটনার বিচার চায় নবীগঞ্জবাসী।
কিন্তু নিখোঁেজর ৯ দিন এবং বস্তাবন্দি লাশ উদ্ধারের ৬ দিন অতিবাহিত হলেও ঘটনার তেমন অগ্রগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। রির্পোট লেখা পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার বা হত্যার কারণ উদঘাটিত হওয়ার খবর পাওয়া যায় নি। তবে পুলিশ বলছে হত্যাকারীদের গ্রেফতারের জোর তৎপরতা চলছে। সম্ভাব্য সকল স্থানে অভিযান চালিয়েও পাওয়া যায় নি। শুক্রবার রাত ব্যাপী প্রেমিক রানু রায়ের গ্রামের বাড়ি বানিয়াচং উপজেলার পুকড়া গ্রামে অভিযান চালিয়েও কাউকে পাওয়া যায় নি। এদিকে শনিবার হবিগঞ্জের সহকারী পুলিশ সুপার সাজিদুর রহমান একদল পুলিশ নিয়ে জয়নগর এলাকায় অভিযান পরিচালনা করেন। সন্ধ্যায় তিনি নিহত তন্নী রায়ের বাসায় যান এবং তার মা-বাবাসহ স্বজনদের সাথে কথা বলেছেন বলে জানাগেছে।
উল্লেখ্য, নবীগঞ্জ শহরে ইতিপুর্বে কয়েকটি গুপ্ত হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছিল। যা অদ্যাবধি পর্যন্ত রহস্য উদঘাটিত হয় নি। এরমধ্যে মধ্য বাজারের মুদি ব্যবসায়ী পুতুল রায়, শহরের নতুন বাজারস্থ সামন্ত মার্কেটে জনৈক দোকান কর্মচারী, রুদ্র গ্রাম সড়কে এক খুইচ্ছা ব্যবসায়ীকে অজ্ঞাতনামা দুর্বৃত্তরা নির্মমভাবে খুন করে।
এছাড়া নবীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কোয়াটারে অঞ্জনা সরকারে হত্যাকান্ড বেশ আলোচিত। তবে শুধু এই হত্যা মামলার আসামীরা সমঝোতায় খালাস পায়। অন্য হত্যাকান্ডের ঘটনা এমনিতেই চাপা পড়ে থাকে বলে জানা গেছে। তন্নী রায়ের লোমহর্ষক হত্যাকান্ডের ঘটনা’র সাথে জড়িত প্রকৃত অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্ঠান্তমূলক শাস্তির দাবী নবীগঞ্জ বাসীর।