সরকারের কোটি কোটি টাকার পাথর যাবে পানির নীচে!
মৌলভীবাজার সদর উপজেলার ২নং মনুমুখ ইউনিয়নের কুশিয়ারা ও মনুনদী ভাঙ্গন রক্ষার জন্য বাংলাদেশ সরকার কোটি কোটি টাকার পাথর বাঁধ দিয়েছিলেন মনুমুখবাজারসহ ৪টি গ্রাম ও সিলেট জেলার পইলনপুর ফাজিলপুর। এবার বালু উত্তোলনের কারণে কোটি কোটি টাকার পাথর ও বাড়িঘর যাবে শত শত ফুট কুশিয়ারা ও মনুনদীর পানির নিচে। এমন অবস্থা চললেও গত ৩ মাসেও নড়ছে না সংশ্লিষ্ট প্রশাসন। অবৈধ বালু উত্তোলনের কারণে ভাঙ্গছে শত শত মানুষের ঘরবাড়ি, মসজিদ, মাদ্রাসা। অব্যাহতভাবে প্রায় ৩ মাস ধরে কুশিয়ারা নদী থেকে বালু উত্তোলন করছেন মৌলভীবাজার সদর উপজেলার শেরপুরের অলী আহমদ গং। দুই জেলার জেলা প্রশাসক, উপজেলা ও থানা বরাবর অভিযোগ করেও কোনো সুরাহা পাননি সিলেট জেলা ও মৌলভীবাজার জেলার ভুক্তভোগী এলাকাবাসী। এরই মধ্যে ড্রেজার মালিক ও এলাকাবাসী দু’পক্ষে তুমুল ঝগড়ার পর বিচার-সালিশ হয় কিন্তু কিছুই মানছে না বালু উত্তোলনকারীরা। এলাকার বাসিন্দা আবুল কালাম আজাদ, আব্দুল আজিজ, মাওলানা ক্বারী আব্দুল বারী, জহুর মিয়া, আব্দুর রাজ্জাক, আব্দুর রহমান, আব্দুল হক, আব্দুর শুকুর প্রমুখ ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, এই দু নদী আমাদেরকে বাড়িঘর ছাড়া করেছে। গরিব, অসহায়, দিনমজুর জেলে প্রকৃতির মানুষ করে রেখেছে। আমাদের রক্ষায় সরকার কোটি কোটি টাকা খরচ করে পাথর দিয়ে বাঁধ দিয়েছিলেন। এখন ড্রেজার দিয়ে প্রতিদিন ৭০ হাজার ফুট বালু ও মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছে প্রভাবশালীরা। এলাকাবাসী জানান, যেখানে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে-সেখানের গভীরতা প্রায় ৪০০ ফুট এবং নদীর দুই পাড়েই ৮-১০ হাত কাছেই মসজিদ, বাজার, ঘরবাড়ি রয়েছে। যখন নদীর পানি একটু কমে আসবে তখন আমাদের ঘরবাড়ি ভাঙ্গন শুরু হবে। আমরা গরিব মানুষ আমাদের মাথাগুজার জায়গা থাকবে না।
সরেজমিনে গিয়ে ড্রেজারের দায়িত্বরত ছাইদুল মিয়ার কাছে বৈধ কোনো কাগজপত্র দেখতে চাইলে ও অলী আহমদের মোবাইল নাম্বার দেওয়ার কথা জানালে তিনি কোনো উত্তর না দিয়ে দ্রুত স্থান ত্যাগ করে চলে যান। কনিকা এন্টারপ্রাইজের ড্রেজার শ্রমিক মাহতাব মিয়ার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রায় দেড়মাস ধরে বালি উত্তোলন করছেন প্রতিদিন ৪/৫ ট্রলার করে। আর এলাকাবাসী বলছেন, প্রতিদিন ৭০ হাজার ফুট বালু উত্তোলন করা হচ্ছে প্রায় ৪ মাস ধরে। এই গভীর জায়গায় আরও গভীর করা হচ্ছে ড্রেজার দিয়ে বালু ও মাটি কেটে নেওয়ায়। যখন নদীর পানি একটু নিচে যাবে তখনই ভাঙ্গন শুরু হবে।
এ ব্যাপারে ফাজিলপুর-পইলনপুর এলাকার বাসিন্দা রেজাউল, রাজা মিয়া, নেকার আহমদ, রুশন মিয়া, আয়তেরা বেগম, জাহানারা বেগম, ছয়ফুন বেগম, ৩নং ওয়ার্ড মেম্বার ছাদিক মিয়া প্রমুখ জানান, আপনারাই দেখেন-এখানে আমাদের ঘরের সাথেই নদীর অবস্থান। প্রতিদিন অবৈধভাবে ৭০ হাজার ফুট বালু উত্তোলন করা হচ্ছে প্রায় ৪ মাস ধরে। আমরা আমাদের ছোটো ছোটো বাচ্চাদেরকে নিয়ে ২৪ ঘণ্টা আতংকে আছি, কখন জানি নদীতে পড়ে মরে যায়, আমাদের ঘুম-নিদ্রা নাই চিন্তায়। কিছুদিন আগে ২নং মনুমুখ ইউপি’র সেফুল মিয়া চেয়ারম্যান, ১নং পূর্ব পইলনপুর ইউপি’র মতিন মিয়া চেয়ারম্যান ও কুশিয়ারা মনুনদীর দু’পাড়ের হাজার লোক মনুমুখ পিটি বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে সালিশের মাধ্যমে নিষেধ করা হয়েছে বালু উত্তোলন না করার জন্য। এমনকি সহস্রাধিক মানুষ স্বাক্ষর করে মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার এবং সিলেটের জেলা প্রশাসকসহ বালাগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবরে অভিযোগ করা হয়েছে-বালু উত্তোলন না করার জন্য। এরপরও অলী গংরা অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করছে। এলাকাবাসী আরও জানান, অলী গংদের খুঁটির জোর কোথায়-তা জানতে চাই আমরা। এ বিষয়ে সিলেট জেলার বালাগঞ্জ উপজেলার ১নং পূর্ব পইলনপুর ইউপি চেয়ারম্যান মতিন মিয়ার সেলফোনে (০১৭১২-৭৫৫৮৭৭) একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। এ ব্যাপারে মৌলভীবাজার সদর উপজেলা চেয়ারম্যান ভিপি মিজানুর রহমান মিজান জানান, বাংলাদেশ সরকার কোটি কোটি টাকা খরচ করে পাথর দিয়ে বাঁধ দিয়েছেন মনুমুখবাজারসহ এ এলাকা রক্ষা করার জন্য। কিন্তু অবাধে বালু উত্তোলন করায় হুমকির মুখে রয়েছেন এখানকার বাসিন্দারা। আমি দু’বার জেলা আইন-শৃঙ্ক্ষলা সমন্বয়ক কমিটির সভায় বলেছি, আর যাতে বালু উত্তোলনের লিজ না দেওয়া হয়।
মৌলভীবাজার সদর উপজেলার ২নং মনুমুখ ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল হক সেফুল জানান, এ ঘটনা নিয়ে মনুমুখ পিটি বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে বিচার হয়েছে। বিচারের দিন আমরা শেরপুরের অলী মিয়ার বালু উত্তোলনের লিজকৃত দাগ নাম্বার ও জায়গা দেখেছিলাম। লিজের কাগজ হলো, সুজননগর গ্রামের বাসিন্দাদের নামে। এখান থেকে ড্রেজার দিয়ে বালু বা মাটি কেটে নিলে সম্পূর্ণ গ্রাম নদীতে চলে যাবে এবং সুজননগরের বাসিন্দাদের সাথে ড্রেজার মালিকদের সংঘাতের সৃষ্টি হবে। তাই আমরা ফাজিলপুরের দিকে বালু উত্তোলন করার জায়গা দেখিয়ে দিয়েছি। কিন্তু কেউ মানছে না। এর জবাবে এলাকাবাসী জানান, চেয়ারম্যান যে জায়গা দেখিয়ে দিয়েছেন এবং ড্রেজার মালিকরা যে স্থান থেকে বালু উত্তোলন করছে সেখানের গভীরতা প্রায় ৪০০ ফুট। ড্রেজার দিয়ে বালু তোলার কারণে যে স্থানে ঘরবাড়ি, হাট-বাজার, মসজিদ, মাদ্রাসা, স্কুল রয়েছে এসব আর থাকবে না। পূর্বে মনুমুখ একটি শহর ছিলো। মৌলভীবাজার হইতে মনুমুখ, মনুমুখ হইতে মৌলভীবাজার পর্যন্ত সরাসরি বাস সার্ভিস ছিলো। ভৈরব, নরসিংদীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ব্যবসায়ীরা এসে ব্যবসা করেছিলেন। এছাড়া বিদেশ থেকে প্রায়ই জাহাজ আসতো পাট নেওয়ার জন্য। এখানে চাম্পা লালের একাধিক পাটের গুদাম ছিলো। এখানকার রেস্ট হাউজ, হাসপাতাল, একটি মাজার, মাদ্রাসা এবং চাঁনপুর, খালপাড় গ্রাম, ফাজিলপুর, পইলনপুর, মনুমুখ শহরসহ ৫টি গ্রাম ভেঙ্গে নিয়ে যায় মনু ও কুশিয়ারা নদী। হাজারও মানুষকে রাস্তায় বসিয়েছে নদী ভাঙ্গন।