দেশ গড়তে জাতীয় ঐক্যের আহ্বান
ডেস্ক রিপোর্টঃ
দেশ গড়তে জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, এখন আমাদের প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য। বিভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধভাবে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। আমাদের ঐক্যের যোগসূত্র হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, অসাম্প্র্রদায়িকতা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, সাম্য ও ন্যায়বিচার এবং উন্নয়ন ও অগ্রগতি। বিজয়ের পর আমরা সরকার গঠন করেছি। সরকারের দৃষ্টিতে দলমত-নির্বিশেষে দেশের সব নাগরিক সমান। আমরা সবার জন্য কাজ করব।
গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ আহ্বান জানান। চতুর্থবার ক্ষমতা গ্রহণের পর এটিই জাতির সামনে দেওয়া প্রধানমন্ত্রীর প্রথম ভাষণ। প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে গত ১০ বছরে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘সরকারি সেবা খাতে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং জাতীয় জীবনের সর্বত্র আইনের শাসন সমুন্নত রাখার উদ্যোগ গ্রহণ করব। জাতীয় সংসদ হবে সব সিদ্ধান্ত গ্রহণের কেন্দ্রবিন্দু। তিনি বলেন, একাদশ জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের সদস্য সংখ্যা নিতান্তই কম। তবে সংখ্যা দিয়ে আমরা তাদের বিবেচনা করব না। সংখ্যা যত কমই হোক, সংসদে যে কোনো সদস্যের ন্যায্য ও যৌক্তিক প্রস্তাব, আলোচনা, সমালোচনার যথাযথ মূল্যায়ন করা হবে। আমি বিরোধী দলের নির্বাচিত সদস্যদের শপথ নিয়ে সংসদে যোগদানের আহ্বান জানাচ্ছি।
দুর্নীতি প্রতিরোধের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি জানি, দুর্নীতি নিয়ে সমাজের সর্বস্তরে অস্বস্তি রয়েছে। দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের নিজেদের শোধরানোর আহ্বান জানাচ্ছি। আইনের কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে দুর্নীতি উচ্ছেদ করা হবে। আমরা তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার সম্প্রসারণের মাধ্যমে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুর্নীতি নির্মূল করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। দুর্নীতি বন্ধে জনগণের অংশগ্রহণ জরুরি। তাই গণমাধ্যমের সহায়তায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনসচেতনতা তৈরির কাজ অব্যাহত থাকবে।
মাদক ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, আপনারা দেখেছেন আমরা জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করে এরই মধ্যে মাদক, জঙ্গি তৎপরতা এবং সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে সফলতা অর্জন করেছি। এ অভিযান অব্যাহত থাকবে। তিনি আরও বলেন, আমরা একটি শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চাই। যেখানে হিংসা-বিদ্বেষ-হানাহানি থাকবে না। সব ধর্ম-বর্ণ এবং সম্প্রদায়ের মানুষ শান্তিতে বসবাস করতে পারবেন। সবাই নিজ নিজ ধর্ম যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে পালন করতে পারবেন।
সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, বৈশ্বিক প্রভাবে কিংবা স্থানীয় প্ররোচনায় আমরা কিছু কিছু তরুণকে বিভ্রান্তির শিকার হয়ে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদে সম্পৃক্ত হতে দেখেছি। ইসলাম শান্তির ধর্ম। ইসলামে সন্ত্রাসের কোনো স্থান নেই। আমি সমাজের সবাইকে মাদকাসক্তি ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছি। তিনি বলেন, ধর্মীয় শিক্ষার প্রসারে আমরা কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছি। মাদরাসা শিক্ষাকে আধুনিকায়নের মাধ্যমে উৎপাদনমুখী করা হচ্ছে। কওমি মাদরাসার দাওয়ারে হাদিস ডিগ্রিকে মাস্টার্স ডিগ্রির সমমানের করা হয়েছে। সারা দেশে ৫৬০টি মসজিদ-কাম-ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার ভাষণে বলেছেন, আমাদের সামনে সবচেয়ে বড় দায়িত্ব শিক্ষিত তরুণদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা। তরুণদের কর্মসংস্থানের জন্য আমরা বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি। এগুলোর মধ্যে রয়েছে তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ শর্তে আর্থিক সহায়তা প্রদানসহ বিভিন্ন সুবিধা নিশ্চিত করা, তরুণ নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ সুবিধা ও প্রণোদনা প্রদান, সরকারি উদ্যোগে কর্মসংস্থান পরিকল্পনা, তরুণ উদ্ভাবকদের উদ্ভাবনগুলো আন্তর্জাতিকভাবে পেটেন্ট করার উদ্যোগ গ্রহণ, দেশ-বিদেশে কর্মে নিয়োগের জন্য কারিগরি বিষয়ে দক্ষকর্মী তৈরি এবং কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন দক্ষ জনবল গড়ে তোলার জন্য প্রতিটি উপজেলায় একটি করে কারিগরি কলেজ স্থাপন করা। এরই মধ্যে কারিগরি কলেজ স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছে।
তরুণদের জন্য কর্মসংস্থানের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, আগামী পাঁচ বছরে আমরা দেড় কোটি কর্মসংস্থানের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছি। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার কাজ এগিয়ে চলেছে। তিনি বলেন, সারা দেশে দুই ডজনের বেশি হাইটেক পার্ক এবং আইটি ভিলেজ নির্মাণের কাজ এগিয়ে চলছে। কৃষি, মৎস্য, পশুপালন, পর্যটন, সেবা খাতসহ অন্যান্য খাতে প্রাতিষ্ঠানিক এবং আত্ম-কর্মসংস্থানের ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি করা হবে।
শেখ হাসিনা বলেন, আমরা চলমান উন্নয়ন প্রকল্পগুলো যথাসময়ে শেষ করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। বিশেষ করে পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, মহেশখালী-মাতারবাড়ি সমন্বিত উন্নয়ন প্রকল্পসহ ফাস্ট ট্র্যাক মেগা প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন কাজে গতি আনা হবে। তিনি বলেন, দেশের প্রতিটি গ্রামে শহরের সুবিধা পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। দেশের প্রতিটি ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে যাবে। ছেলেমেয়েদের উন্নত পরিবেশে লেখাপড়ার সুযোগ তৈরি করা হবে। সুপেয় পানি এবং উন্নতমানের পয়োঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হবে। সুস্থ বিনোদন এবং খেলাধুলার জন্য অবকাঠামো গড়ে তোলা হবে। ইন্টারনেট, তথ্যপ্রযুক্তি সর্বত্র পৌঁছে যাবে।
তরুণদের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আশা প্রকাশ করে বলেন, তরুণেরাই দেশের ভবিষ্যৎ কর্ণধার। তারুণ্যের সৃষ্টিশীলতা, উদ্যম এবং শক্তির ওপর আমাদের পূর্ণ শ্রদ্ধা ও আস্থা রয়েছে। তারুণ্য মানেই বাংলা ভাষার জন্য আত্মদান, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, আসাদ-মতিউর, নূর হোসেনদের রক্তদান। তারুণ্য মানেই লাল-সবুজের পতাকা-আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি, তারুণ্য মানেই বাঙালি এবং বাংলাদেশ।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৭১ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে বাঙালি জাতি মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন করেছিল। আর ২০১৮ সালে আরেক বিজয়ের মাসে এ দেশের ভোটাররা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে বিজয়ী করেছে, আমাদের দেশ সেবার সুযোগ করে দিয়েছে। তিনি আরও বলেন, আমি আগেও বলেছি, আবারও বলছি, আমার ব্যক্তিগত কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই। বাবা-মা-ভাই, আত্মীয়-পরিজনকে হারিয়ে আমি রাজনীতি করছি শুধু জাতির পিতার স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য; এ দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য। এ দেশের সাধারণ মানুষ যাতে ভালোভাবে বাঁচতে পারেন, উন্নত-সমৃৃদ্ধ জীবনের অধিকারী হতে পারে, তা বাস্তবায়ন করাই আমার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য।
এ সময় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্ধৃতি দিয়ে তার কন্যা শেখ হাসিনা বলেন, ‘মহৎ অর্জনের জন্য মহৎ ত্যাগের প্রয়োজন।’ আমরা তরুণদের শক্তি, মেধা ও মননকে সোনার বাংলা গড়ার কাজে সম্পৃক্ত করব। আজকের তরুণেরাই পারবে দেশকে উন্নতি ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি আনতে।
২০২০ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর কথাও তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে আমরা ২০২০-২১ সালে মুজিব বর্ষ এবং ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উৎসব উদ?যাপন করব। বাঙালি জাতির এই দুই মাহেন্দ্রক্ষণে আমরা দেশকে আর্থসামাজিক খাতে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে চাই। আর এর কৌশল হিসেবে আমরা ভিশন ২০২১ এবং ভিশন ২০৪১ বাস্তবায়ন করছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জলবায়ুর ঘাত-প্রতিঘাত মোকাবিলা করে কাক্সিক্ষত উন্নয়ন অর্জনের জন্য আমরা ‘বাংলাদেশ বদ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০’ নামে শতবর্ষের একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছি। আমরা এরই মধ্যে সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সঙ্গে এসডিজির লক্ষ্যমাত্রাগুলো সম্পৃক্ত করে তা বাস্তবায়ন শুরু করেছি। অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজও শুরু হয়েছে।
পররাষ্ট্রনীতির বিষয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়’Ñ আমাদের এই পররাষ্ট্রনীতিই বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্কের মূল হাতিয়ার। এই নীতির সফল বাস্তবায়ন বাংলাদেশকে উন্নতি ও অগ্রগতির পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক যে কোনো সময়ের চেয়ে সুদৃঢ় এবং গভীর।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলমত-নির্বিশেষে সবার সহযোগিতা কামনা করে তার ভাষণ শেষ করেন। তিনি বলেন, নবীন-প্রবীণের সংমিশ্রণে আমি আমার মন্ত্রিসভা গঠন করেছি। প্রবীণদের অভিজ্ঞতা আর নবীনদের উদ্যম, এই দুইয়ের সমন্বয়ে আমরা আমাদের লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছার প্রত্যয় ব্যক্ত করছি। তিনি আরও বলেন, আপনারা আমার ওপর আস্থা রেখে যে রায় দিয়েছেন, কথা দিচ্ছি আমি প্রাণপণ চেষ্টা করব সে আস্থার প্রতিদান দিতে। এ জন্য দলমত-নির্বিশেষে দেশের সব নাগরিকের সমর্থন এবং সহযোগিতা চাই। আপনাদের সহযোগিতায় আমরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের ক্ষুধা, দারিদ্র্য, নিরক্ষরতামুক্ত অসাম্প্রদায়িক সোনার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করব, ইনশা আল্লাহ।
কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের একটি কবিতা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণ শেষ করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ভাষায় বলতে চাই,
‘যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি-
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার। “