সোনারগাঁও-এর ঘটনা সবদিকেই দুঃখজনক।
*
সৈয়দ মবনু
*
দয়াদর্শন মনে করে; জ্ঞান, বুদ্ধি, কর্মের মধ্যে সমন্বয়ের পর প্রেম, নতুবা প্রেম হয়ে যাবে প্লাস্টিকের পাত্রে এসিড রাখার মতো বিষয়। আমি শায়খুলহাদিস আল্লামা আজিজুল হক (র.)-কে ভালোবাসতাম এবং ভালোবাসি। আমি যাকে ভালোবাসি তাঁর আত্মীয়-স্বজনকে আমি তাঁর মতোই দেখার চেষ্টা করি। আমি বন্ধু সবাইকে বলি না। কিন্তু যাকে বন্ধু বলি তাকে নিজের ভাইয়ের মর্যাদা দেওয়ার চেষ্টা করি। বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে অনেক সময় দেখা যায়, আমি যাকে বন্ধু মনে করি সে কিন্তু আমাকে সে রকম ভালোবাসে না। অবশ্য এতে আমার কিছু আসে যায় না। শায়খুলহাদিস আল্লামা আজিজুল হক (র.)-এর দ্বিতীয় ছেলে হাফিজ মাওলানা মাহবুবুল হক আমার কৈশোরের বন্ধু। এই বন্ধুত্বের যাওয়া-আসা খুব গভীরভাবেই ছিলো হুজুর যতদিন বেঁচে ছিলেন। হুজুরের ইন্তেকালের পর আর তেমন যাওয়া-আসা হয় না। তবে আমি মনে করি না যে বন্ধুত্বে কোন ঘাটতি হয়েছে। তবে যোগাযোগে কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। আমি যে সময়ের কথা বলছি সেই সময় হাফিজ মাওলানা মামুনুল হক বেশ ছোট। শায়খুলহাদিসের চার ছেলের মধ্যে প্রথম হলেন হাফিজ মাহমুদ ভাই, দ্বিতীয় মাহবুব, তৃতীয় হাফিজ মাওলানা মাহফুজুল হক, চতুর্থ হলেন হাফিজ মাওলানা মামুনুল হক। বযসে ছোট হলেও মাওলানা মামুনুল হক জনপ্রিয়তায়, দেহে এবং যোগ্যতায় অনেক বড় হয়ে আছেন। আমি মামুনুল হকের কিছু কাজের সমালোচনা মাঝেমধ্যে করি বলে অনেকে মনে করেন আমি সম্ভবত তাকে পছন্দ করি না বা হিংসা করি। প্রকৃত অর্থে তা নয়। কারণ, শায়খুলহাদিস কিংবা তাঁর দ্বিতীয় ছেলে মাহবুবের সাথে আমার প্রেম ছিলো এবং আছে। এই প্রেম কিন্তু আবেগে নয়, তা দয়াদর্শনের প্রেম। এই প্রেমের পূর্বে জ্ঞান, বুদ্ধি, কর্মের সমন্বয় রয়েছে। এই দুই জনের প্রেমই আমাকে তাদের পরিবারের সবার প্রতি এক প্রকারের দূর্বলতা তৈরি করে রেখেছে। মাঠে খেলতে গেলে ফাউল হয়। পনেরো শ বছর পরের উম্মত, ভুল হওয়াটা বিচিত্র কিছু নয়। ভুল মানুষেরই হয়। ওরা কেউ নবী-রাসুল কিংবা ফেরেস্তা নয়। তারা কেউ কেউ যখন ভুল করেন তখন সংশোধনের নিয়তে সমালোচনা করি, যাকে ইসলামী ভাষায় ইহতেসাব বলে। আমাদের আবেগের অবস্থা এমন পর্যায়ে যে, আমরা বুঝতে পারি না কোনটা সংশোধনীর সমালোচনা এবং কোনটা শত্রুতার। ফলে আমরা সমালোচনাকে সহ্য করতে পারি না। আল্লামা আহমদ শফি (র.) ও হাটাজারীর ইস্যুতে মাওলানা মামুনুল হকের যে ভূমিকা ছিলো তা আমাদের কাছে সুন্দর মনে হয়নি, তাই বিনয়ের সাথে বারবার তাকে বলেছি এই ভূমিকা থেকে পিছু যেতে। বলেছি শায়খুল ইসলামের কাছে ক্ষমা চাইতে। শায়খুল ইসলামের মৃত্যুর পর বলেছি, তাওবাহ করে তাঁর কবর জিয়ারতে গিয়ে রুনাজারি করতে। নতুবা যে ক্ষতি হবে তা ভাষা দিয়ে বলতে পারবো না। আমার বক্তব্যকে অনেকে ভুল বুঝেছেন এবং গালাগালি করেছেন। আল্লাহ আমাদেরকে মাফ করুন। আমি আবারও বলছি, আমার শ্রদ্ধেয় শায়খুল হাদিস (র.)-এর ছেলে হাফিজ মাওলানা মামুনুল হকের উচিৎ শায়খুল ইসলাম আল্লামা আহমদ শফি (র.)-এর সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনার জন্য তাওবাহ করা এবং শায়খুলইসলামের বৃদ্ধা স্ত্রী এখন বেঁচে আছেন, প্রয়োজনে তাদের বাড়িতে গিয়ে এই মহিলার কাছে মাফি চাওয়া উচিৎ। আমার কথা খারাপ লাগতে পারে। কিন্তু চিন্তা করে দেখবেন। আমি প্রায় সময় একটি কথা ভাবি, যেতে যেতে মানুষটা কি যে বলেগেলো তাঁর প্রভূর কাছে? আমার হৃদয়ের কানে প্রায় ধ্বনিত হয় শায়খুল ইসলামের হৃদয়-ভাঙা দীর্ঘশ্বাস। আল্লাহ আমাদের সবাইকে মাফ করেদিন।
৩ এপ্রিল ২০২১ সোনারগাঁও-এ যে ঘটনা ঘটেছে তা সবদিকেই দুঃখজনক। এই ঘটনাকে নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে বিতর্ক চলছে। আমি যতটুকু খবর নিয়েছি তা থেকে বুঝতে পেরেছি, হাফিজ মাওলানা মামুনুল হকের কথাই সত্য; ‘আমেনা তৈয়বা’ তাঁর স্ত্রী। তবে প্রথম কিংবা প্রথমের মতো সর্বজন স্বীকৃত নয়, তা গোপন এবং দ্বিতীয়। যদি বিয়ে সত্য হয় তবে শরিয়তের আইনের দৃষ্টিতে মামুনুল হক কোন অপরাধ করেননি। আর যদি বিয়ে সত্য না হয় আর ‘আমেনা তৈয়বা’ তাঁর বান্ধবী হয়, প্রাপ্তবয়স্ক হয়, তবে বৃটিশ পদ্ধতির আইনের দৃষ্টিতে তা অপরাধ নয়। আর যদি নারী হয় লাইসেন্সপ্রাপ্ত পতিতা তবে রাষ্ট্রীয় আইন বিভিন্ন রাষ্ট্রে বিভিন্নভাবে কার্যকর হয়। সামাজিক আইন একেক সমাজে একেক রকম। আবার সমাজেও সামাজিক আইন একেকজনের জন্য একেক রকম। পারিবারিক আইনেও ভিন্নতা রয়েছে। কোন কাজ অপরাধ এবং কোন কাজ অপরাধ নয় তা নির্ভর করে এই আইনগুলোর চিন্তা-চেতনার উপর।
(‘আমেনা তৈয়বা’) বা জান্নাত আরা ঝর্ণা হাফিজ মাওলানা মামুনুল হকের বিয়ে করা স্ত্রী কি না? তা আমি জানি না। তবে রাষ্ট্রীয় আইনে কাবিন ছাড়া বিয়ে গ্রাহণযোগ্য নয়। কিন্তু ইসলামী আইনে ‘মহর’ আর ‘দুজন স্বাক্ষী’ হলেই বিয়ে গ্রহণযোগ্য। দ্বিতীয় বিয়ের ক্ষেত্রে ইসলামের বিধানকে আমরা যত সহজ মনে করি প্রকৃত অর্থে তত সহজ নয়। এক্ষেত্রে শর্ত খুব কঠিন। অনেক পুরুষ মনে করেন, ইসলাম দ্বিতীয় বিয়ের প্রতি উৎসাহিত করেছে। কিন্তু তা এভাবে সত্য নয়। ইসলাম প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং চতুর্থ বিয়েকে বৈধতা দিয়েছে শর্ত-সাপেক্ষ। এই শর্ত পাওয়া না গেলে ইসলাম বলেছে বিয়ে না করে রোজা রাখতে। মাওলানা মামুনুল হকের এই শর্তগুলোর কথা অবশ্যই জানা আছে এবং তিনি আশা করি এই শর্তগুলো পূর্ণ করেই দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন। যদি শরিয়তের শর্ত পূর্ণ করে তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করে থাকেন তবে শরিয়তের দৃষ্টিতে তা পাপ বা অন্যায় নয়। আমাদের রাষ্ট্রীয় আইনে দ্বিতীয় বিয়ের ক্ষেত্রে একটি শর্তে রয়েছে, প্রথম স্ত্রীর অনুমতি। মামুনুল হকের প্রথম স্ত্রীর অনুমতি রয়েছে কি না তা আমার জানা নেই। থাকলে ভালো। না-থাকলে আশা করি ইতোমধ্যে আপোষ হয়েগেছে। সংসার জীবন আইন-আদালত আর বিচার দিয়ে চলে না, তা চলে আপোষের মাধ্যমে। সংসারে আপোষ হওয়াটা সুখ-শান্তির জন্য জরুরী।
সোনারগাঁও-তে মামুনুল হক গিয়েছিলেন মাইন্ড ফ্রেস করতে কিংবা বিনোদনের জন্য। কারো কারো প্রশ্ন, ১৭টি লাশ আর অসংখ্য আহত রেখে তার কি এখন বিনোদনের সময়? কেউ বলছেন, আহতরা চিকিৎসার টাকা পাচ্ছে না আর তিনি বিলাসবহুল হোটেলে দ্বিতীয় স্ত্রী নিয়ে ইসরাফ খরচ করছেন? তা কি ন্যায়সঙ্গত হচ্ছে? তার খুব ঘনিষ্ঠদের বক্তব্য হলো, তিনি তো কারো পরামর্শ মানেন না, কারো সাথে পরামর্শ করেন না, যা নিজের মনে কয় তা করেন। আপনজনদের কেউ এমনও বলেছেন, স্ত্রী সত্য হলেও উচিৎ ছিলো নিজ গাড়ীতে যাওয়া, ড্রাইভারকে সাথে রাখা, নিজ খাদেমকে সাথে রাখা ইত্যাদি। তিনি এগুলো কিছুই করেন নি। তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অভাবে এমন ঘটনা ঘটেছে।
তবে যারা আক্রমন করেছেন মামুনুল হকের উপর আমি তাদেরকে সমর্থন করি না। কারণ, কেউ অপরাধী হলেও তার উপর বিচার করার অধিকার আদালতের, অন্যকারো নয়। ছাত্রলীগ, যুবলীগ, আওয়ামীলীগ, খেলাফত মজলিস, জামায়াত ইত্যাদি কারোই দায়িত্ব নয় বিচারকার্য নিজের হাতে উঠিয়ে নেওয়ার। কেউ অন্যায় করলে তারা অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারেন। অন্যায়কারীকে পুলিশের কাছে দিতে পারেন। কিন্তু নিজেরা হাত উঠানোর অধিকার রাখেন না। যারা সরকারী দল তাদের আরও দায়িত্বশীল হওয়া উচিত ছিলো। সরকারী দলের লোক, আপনারা সরকারকে সহযোগিতা করতে পারেন, কিন্তু আইনকে নিজ হাতে উঠিয়ে নয়, আইনকে সহযোগিতা করে। আপনারা যদি আইনের শাসনকে সম্মান না দেন তবে জনগণ আইন সম্মান করবে কীভাবে? এতে ধীরে ধীরে সরকারই বেকায়দায় আটকে যাবে।
সবশেষে বলবো, সবাইকে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে। জ্ঞান বুদ্ধি কর্ম এবং প্রেমের সমন্বয়ে সবার মধ্যে দয়াকে জাগাতে হবে। সবাইকে আদব শিখতে হবে, শালিনতা, ভদ্রতা শিখতে হবে। আমরা মানুষ, মানুষকে সম্মান করা শিখতে হবে। অন্যকে সম্মান করলে প্রকৃত অর্থে নিজের সম্মান বৃদ্ধি হয়।