জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের দাবিতে সোচ্চার নাগরিক সমাজ

গণজাগরণ মঞ্চের তরুণ প্রজন্মের আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছে নাগরিক সমাজ। আজ শনিবার রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে নাগরিক সমাজের মহাসম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনের ঘোষণাপত্রে ওই দাবি জানানো হয়।
সম্মেলনে নাগরিক সমাজের বক্তারা অভিযোগ করেন, একাত্তর সালের মতোই ২০১৩ সালে জামায়াত-শিবির স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলায় বিরোধী দলের নেত্রী খালেদা জিয়া শাহবাগের তরুণদের সমালোচনা করে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তারও নিন্দা জানায় নাগরিক সমাজ।
ঘোষণাপত্রে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার কার্যক্রম শুরুর পর থেকে জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডসহ দেশজুড়ে তাদের সাম্প্রতিক তাণ্ডবের বিস্তারিত তুলে ধরা হয়। এসব কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে শ্বেতপত্র প্রকাশের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানানো হয়। সম্মেলনে যোগ দেন দেশের শীর্ষস্থানীয় শিক্ষক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, মানবাধিকারকর্মীসহ বিশিষ্ট নাগরিকেরা। সকাল থেকে চলা ওই সম্মেলনে ঘোষণাপত্র উপস্থাপন করেন সম্মেলনের অন্যতম উদ্যোক্তা মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি সারোয়ার আলী। জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করার জন্য নাগরিক সমাজের আন্দোলনকে বৃহত্তর রূপ দিতে শিগগিরই একটি জাতীয় কমিটি গঠন করার উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে সম্মেলনে জানানো হয়েছে। সম্মেলনে নাগরিকদের দেওয়া বক্তব্যে উঠে আসে বিভিন্ন প্রসঙ্গ।
জামায়াতের আর্থিক ক্ষমতার উত্স বন্ধ করতে হবে: আনিসুজ্জামান
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে হলে তাদের আর্থিক ক্ষমতার উত্স রুদ্ধ করতে হবে। তিনি বলেন, ‘অনেকেই বলেন, দেশ এখন দ্বিধাবিভক্ত। কিন্তু আমি বলব, যেদিন বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছিল, যেদিন সামরিক ফরমান বলে সংবিধানের মূলনীতি ধ্বংস করা হয়েছিল, যেদিন শাহ আজিজুর রহমান এ দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন, সেদিন থেকে দেশ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছিল। একদিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করা শক্তি, অন্যদিকে এর বিপক্ষ শক্তি।’
জামায়াতের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডকে একাত্তরের তাণ্ডবের সঙ্গে তুলনীয় উল্লেখ করে আনিসুজ্জামান বলেন, জানুয়ারি থেকে তারা হুমকি দিচ্ছে, মানবতাবিরোধী অপরাধ-সম্পর্কিত ট্রাইব্যুনাল ভেঙে দিতে হবে। অপরাধীদের বিচার করা যাবে না। করলে দেশে গৃহযুদ্ধ লেগে যাবে। ক্ষেত্র তৈরির জন্য তারা ব্লগার রাজিবকে হত্যা করেছে। দেশের পতাকা পুড়িয়েছে। শহীদ মিনার ভেঙেছে। সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে আগুন দিয়েছে। বিএনপির সমর্থন পেয়ে তাদের এই আস্ফাালন বেড়েই চলেছে।
বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়াকে মুনীর চৌধুরীর ‘নষ্ট ছেলে’ বইটি পড়ার অনুরোধ জানিয়ে আনিসুজ্জামান বলেন, ‘খালেদা জিয়া শাহবাগের তরুণ প্রজন্মকে নষ্ট ছেলে-মেয়ে বলেছেন। মাথা হেঁট হয়ে যায়। অথচ শাহবাগ একাত্তরের চেতনাকে নতুন করে প্রতিষ্ঠিত করেছে। মাথা নত করে আমি তাদের শ্রদ্ধা জানাই।’
আনিসুজ্জামান বলেন, শাহবাগে যেভাবে ফাঁসির দাবি করা হচ্ছে, তা সমর্থনযোগ্য নয়। তবে বিচারের দাবি অবশ্যই করতে হবে এবং সেই বিচারের দায়িত্ব আদালতের ওপর ছেড়ে দিতে হবে।
দ্রুত আইন প্রয়োগ করে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে হবে: আকবর আলি খান
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আকবর আলি খান বলেন, সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প দেশকে তছনছ করে দেয়। এর নিকৃষ্ট উদাহরণ পাকিস্তান। শান্তিতে মসজিদের নামাজও পড়া যায় না। অনেক সময় রাজনৈতিক সমস্যা আইন দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না। অনেক রাজনৈতিক শক্তির উত্থান ঘটে, যারা নিজেরা আইন মানে না। আবার বিপদে পড়লে আইনের আশ্রয় নেয়। কিন্তু জামায়াত এখন যে পর্যায়ে তাতে রাজনৈতিক বিবেচনার সুযোগ নেই। দ্রুত আইন প্রয়োগ করে দলটিকে নিষিদ্ধ করতে হবে।
আকবর আলি বলেন, যারা দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবেশকে দুর্বিষহ করে তুলেছে, তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। তবে তা করতে হবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে। একই সঙ্গে আগামী নির্বাচন যাতে সুষ্ঠু হয়, সেদিকেও নাগরিক সমাজকে লক্ষ রাখতে হবে। নির্বাচন না হলে গণতন্ত্র রক্ষা পাবে না। আর গণতন্ত্র না থাকলে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বাস্তবায়ন করা যাবে না।
জামায়াতের কর্মকাণ্ডের শ্বেতপত্র প্রকাশ করতে হবে: আমীর-উল ইসলাম
জামায়াত গত কয়েক সপ্তাহে যা করেছে, তার শ্বেতপত্র প্রকাশের দাবি জানিয়ে আমীর-উল ইসলাম বলেন, ‘আমরা অপরাধ সহনের রাষ্ট্র তৈরি করিনি। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের রায় প্রকাশের পর যেভাবে মানুষ হত্যা করা হয়েছে, যেভাবে সংখ্যালঘুদের নির্যাতন করা হয়েছে, তার বিপরীতে সরকার কার্যকর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। সঠিকভাবে একটি প্রেসনোটও দেয়নি। কক্সবাজারের রামুতে যা ঘটেছিল, সেখানে সরকারের একটি অংশ জড়িত ছিল।’ তিনি প্রশ্ন তুলে বলেন, ‘জড়িতদের বিরুদ্ধে সরকার কী ব্যবস্থা নিয়েছে?’
জামায়াতের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালাতে হবে: খলীকুজ্জমান
অর্থনীতিবিদ কাজী খলীকুজ্জমান বলেন, ‘এত দিন তরুণ প্রজন্মের জাগরণের প্রতি আমরা বিচ্ছিন্নভাবে বিবৃতি দিয়েছি, সংগঠিত হতে পারিনি।’ এখন গণজাগরণ মঞ্চকে অনুসরণ করতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি। জামায়াত তাদের সন্ত্রাসের ডালপালা বিস্তৃত করেছে অভিযোগ করে খলীকুজ্জমান বলেন, ‘চুপচাপ বসে থাকা যাবে না। সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।’
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও শিকড় গাড়ছে জামায়াত-শিবির: আনোয়ার হোসেন
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘জামায়াত-শিবির এখন স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের শিকড় গাড়তে শুরু করেছে। ব্যবসায়িক ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে তারা সক্রিয়। হেফাজতে ইসলাম তাদের অঙ্গ সংগঠন, যা নিয়ে আমরা শঙ্কিত। সুতরাং আর বাড়ার সুযোগ না দিয়ে এখনই জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে হবে। এ বিষয়ে সরকারপক্ষ ভয় পেলে চলবে না।’
জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে দ্বিধা থাকা উচিত নয়: সুলতানা কামাল
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) চেয়ারম্যান সুলতানা কামাল বলেন, ‘জামায়াত যে তাণ্ডব চালাচ্ছে, তা একাত্তরের তাণ্ডবের প্রতিচ্ছবি। তখন তারা পাকিস্তানের অখণ্ডতার নামে হত্যা আর লুটপাট করেছিল। বুদ্ধিজীবী হত্যার পিছনে পাকিস্তানিদের চেয়ে জামায়াতের ভূমিকা বেশি ছিল। এখন তারা যা করছে, তাতে দলটিকে নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে কারও কোনো দ্বিধা থাকা উচিত নয়। এ দাবি সভ্যতা ও গণতন্ত্রের। এ বিষয়ে সবাইকে কথা বলতে হবে। যাঁরা ভালো মানুষ, অথচ কথা বলেন না, তাঁরা সমাজে না থাকার সমান হয়ে যান।’
মহাসম্মেলনের সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক, সুশাসনের জন্য নাগরিকের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার, সামরিক বিশেষজ্ঞ আমিন আহমেদ চৌধুরী, অর্থনীতিবিদ এম এম আকাশ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আলী যাকের, নারীনেত্রী খুশী কবির, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু, মুক্তিযোদ্ধা কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের চেয়ারম্যান হেলাল মোর্শেদ ও শিল্পী মিতা হক। সমাবেশে আরও উপস্থিত ছিলেন, অজয় রায়, এ কে এম নূরন্নবী, আবেদ খান, মুনতাসীর মামুন, ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী, শ্যামলী নাসরীন চৌধুরী, হারুন হাবীব, পান্না কায়সার, পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়, ম. হামিদ, তানিয়া আমীর, রোকেয়া প্রাচী প্রমুখ।