আগর থেকে সুগন্ধি তেল উৎপাদন সম্ভব : মৌলভীবাজারের আগর চাষ অর্থনীতির দ্বার খুলে দিতে পারে

জালাল আহমদ : মৌলভীবাজারের আগর শিল্প হতে পারে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন ও বেকারদের কর্মসস্থানের বড় মাধ্যম। সরকারি ও বেসরকারী পৃৃষ্ঠপোষকতা, কাঁচামালের সমস্যা নিরসনসহ ঋণ সুবিধা পেলে ব্যক্তি উদ্যেগে আগরের চাষ বৃদ্ধি পেতে পারে। আগরের চাষাবাদ বৃদ্ধি পেলে উৎপাদিত আতর বিদেশে রফতানির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারে সরকার। বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী আগর শিল্প সারা বিশ্বে পরিচিত থাকলেও যতেষ্ঠ পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এ শিল্পের বিসত্মার লাভ করছে না। সুগন্ধি আতর ও আগর মোগল আমল থেকে সুনাম ও সমাদর সর্বত্র থাকলেও নানা প্রতিকুলতার কারণে আগর চাষ প্রায় শূন্যের কোটায়। বিভিন্ন সমস্যার কারণে দেশ-বিদেশে সুপ্রসিদ্ধ সুগন্ধি আতর ও আগর শিল্প এখন বিলুপ্তির পথে।
আগর চাষের ঐতিহাসিক তথ্য অনুসন্ধানে জানা গেছে, সুগন্ধি আতরের নির্যাসের উৎস আগরের চাষ করা হতো মোগল আমল থেকে। পাহাড়ি এলাকায় আগরে গাছ কখন, কিভাবে, কে রোপণ কিংবা আবিষ্কার করেছিলেন তার কোন সুস্পষ্ট তথ্য জানা যায়নি। আগর গাছের ইংরেজি নাম একোলিয়ারা একোলোহা। ৭ বছরে ৬০/৭০ ফুট উঁচু আগর গাছ পুর্ণতা লাভ করে। মোগল আমলে দেশ-বিদেশের সম্রাটদের দূতের আগমন ঘটতো মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার সুজানগরে। পরবর্তীতে এটি আগর-আতরের গ্রাম হিসেবেই প্রতিষ্ঠা লাভ করে। আগরের নির্যাস থেকে প্রাপ্ত আতরের একমাত্র উৎপাদন স্থল ছিল বড়লেথা উপজেলার সুজানগর। দেশে-বিদেশে ব্যাপক চাহিদা থাকলেও পৃষ্ঠপোষকতা, কাঁচামাল ক্রয়ে জটিলতা ও সরকারি উদ্যোগের অভাবে আগর শিল্প বিলুপ্তির পথে। মধ্যপ্রাচ্যের কাতার, দুবাই, আরব আমিরাত, সৌদিসহ বিভিন্ন দেশে এখানকার আতরের চাহিদা রয়েছে। প্রায় আড়াই’শ বছর আগে সিলেট বিভাগে আগর চাষের কথা শোনা যায়। কিন্তু নানা সমস্যা ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ১৯৪৭ সাল থেকে বিদেশ থেকে আগর গাছ আমদানি করে কোনভাবে ঠিকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করেন কিছু আগর চাষী। পাকিসত্মান শাসনামলে সরকারিভাবে সিলেট বিভাগে আগর চাষের উপর একটি জরিপ চালিয়ে পুসিত্মকা প্রকাশ করা হয়। কিন্তু উন্নয়নে ভূমিকা না নেওয়ায় অবহেলিত হয়ে পড়ে আগর শিল্প। আশার কথা হলো- ১৯৯৪-১৯৯৫ সালে প্রথম আগরের গুরম্নত্ব অনুধাবন করে পরীক্ষামূলক চাষের উদ্যোগ নেয় বনবিভাগ। এ সময় ২ হাজার ৫০০ আগরের চারা রোপণ করা হয় শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জ উপজেলার মাগুরছড়া ও লাঠিটিলা পাহাড়ে। ১৯৯৬ সালে সরকার এদিকে দৃষ্টি দেওয়ার পর প্রাথমিকভাবে ৫ হাজার আগর চারা লাগিয়ে বনায়নের কাজ শুরম্ন করা হয়। ৫ বছরে এর সফলতা দেখে ২০০০ সালে আরো একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। আতরের কাঁচামালের স্বল্পতা ও আগর বিলুপ্তি রোধে সরকার কর্তৃক প্রকল্পের মেয়াদ প্রায় শেষ পর্যায়ে। এ পর্যনত্ম ১২টি পাহাড়ি এলাকার ৩৫২ হেক্টরে ৩ লাখ ৪০ হাজার চারা রোপণ করা হয়েছে। এ প্রকল্প বাসত্মবায়িত হলে ৪০ বছরের মধ্যে আগর বিলুপ্তির আশংকা কেটে যাবে বলে বনবিভাগ সূত্র জানিয়েছে।
সিলেট মাগুরছড়া, তারাকান্দি, মৌলভীবাজারের বড়লেখা ও জুড়ী, হবিগঞ্জের সাতছড়ি, চুনারম্নঘাট, রঘুনন্দন ও কালেঙ্গা এবং সিলেটের খাদিমনগরে ও শ্রীমঙ্গলস মৌলভীবাজার রেঞ্জের আওতায় সাতগাঁও বিটের পাহাড়ি ন্যাড়া ভূমিতে অংশদারিত্বের ভিত্তিতে সাড়ে ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ৩ লাখ ৪০ হাজার আগরের চারা রোপণ করা হয়েছে। যা সরকারি উদ্যোগে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে আগর চাষ ও আগর শিল্পকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষার উলেস্নখযোগ্য ভূমিকা রাখবে বলে বন বিভাগের সংশিষ্টদের অভিমত।
সিলেট বিভাগের মধ্যে মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া, আগরের জন্য সিলেট সুপরিচিত সেই প্রাচীনকাল থেকেই। রোপিত একটি আগর গাছ ৫ বছরে আগরসমৃদ্ধ হয়ে থাকে। সৌদি, কাতার, আরব আমিরাত থেকে ব্যবসায়ীরা সিলেট তথা মৌলভীবাজার যেতেন আতর ও কাঁচামাল ক্রয় করতে। সরকারি ব্যবস্থাপনা না থাকলেও ব্যক্তি উদ্যোগে আতরের কারখানায় আগর থেকে আতরের নির্যাস সংগ্রহ করা হতো। বর্তমানে দেশে আগরের নির্যাস থেকে আতরের কারখানা রয়েছে বড়লেখার সুজানগরে ও সিলেটের খাদিমনগরে। তন্মধ্যে সুজানগরে রয়েছে ৩০০ টি আগরের কারখানা। এখানে ব্যক্তি উদ্যোগে আগরের চাষ করা হচ্ছে। সরকারিভাবে এখনও কোন আগরের কারখানা করা হয়নি। বড়লেখার সুজানগরের আতরের কারখানা থেকে প্রতি মাসে গড়ে ৪ হাজার তোলা আতর সংগৃহিত হয়। যার বাজার মূল্য ৫ কোটি টাকা বলে আতর কারখানার মালিকরা জানান।
মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলায় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে আগর চাষের ইতিহাস প্রাচীন। তবে সরকারি উদ্যোগে আগর চাষ করা হয়নি। ব্যক্তি উদ্যোগে সুজানগরে এ শিল্প কোনভাবে ঠিকে আছে। আগরের চাষাবাদ বৃদ্ধি ও এ শিল্পকে রক্ষায় সরকারি উদ্যোগের ব্যাপারে সরকার এ দিকে দৃষ্টি দিয়েছে। আতর তৈরির প্রধান উপাদান আগর গাছ বনায়নের কার্যক্রম বাসত্মবায়নের মধ্য দিয়ে বিলুপ্তির হাত থেকে এ শিল্পকে রক্ষার সরকারি প্রয়াস চালনো হচ্ছে বলে বনবিভাগ সূত্র জানিয়েছে।
আগরচাষীদের সাথে আলাপকালে জানা যায়, সরকারি উদ্যোগে আগর বনায়ন প্রকল্প বাসত্মবায়িত হলে ও পষ্ঠপোষকতাসহ সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা দেওয়া হলে ব্যক্তি উদ্যোগে আগরের চাষ বৃদ্ধি পাবে। ফলে আগরের চাষাবাদ বৃদ্ধি ও আতর বিদেশে রফতানির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারে সরকার। শুধু তাই নয়, এ শিল্পের সাথে জড়িত হাজার হাজার মানুষও হতে পারবে স্বাবলম্বী। সুগন্ধি আতর ও আগর শিল্পকে যথাযথ পৃষ্টপোষকতার মাধ্যমে দেশের বিশাল বেকারত্বের কর্মসংস্থানের সৃষ্টিসহ বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ভাবমূর্তি বৃদ্ধিতে হতে পারে একটি বড় মাধ্যম। প্রবাসী বিনিয়োগ উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসা প্রয়োজন বলে মনে করেন অভিজ্ঞমহল।
বড়লেখা উপজেলার সুজানগরের প্রবাসী আলহাজ্ব শামছুল হক জানান, তিনি ৫০ বিঘা জমিতে আগর চাষ করেছেন। এখানকার বনবিট কর্মকর্তা মনিরম্নল হক জানান, সরকারি উদ্যোগে বন বিভাগ মাধবছড়া বিটে ৭০ হেক্টর ভূমিতে ১ লাখ ১২ হাজার আগর চারা রোপণ করা হয়েছে। এখানের আগরচাষীদের সাথে আলাপ করে জানা গেছে, আগর গাছ রোপণের কমপক্ষে ৪ বছর পর পুরো গাছে পেরেক ঢুকিয়ে আরো ৩ বছর রেখে দেওয়া হয়। তারপর গাছ কেটে ছোট ছোট টুকরো করে কিছুদিন পানিতে ভিজিয়ে রাখা হয়। এরপর বিশেষভাবে নির্মিত চুলিস্নতে তাপ দিয়ে সিদ্ধ শেষে বিশেষ পদ্ধতিতে আগর থেকে মূল্যবান আতর তৈরি করা হয়।
আগরচাষীরা অভিযোগ করে জানান, একটি পরিপূর্ণ গাছ কাটতে তাদের বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। গাছ কাটার আগে ভূমি অফিস থেকে হোম পারমিট, বন বিভাগ থেকে ট্রানজিট পাস ইত্যাদি সংগ্রহ করতে হয়রানির শিকার হতে হয় তাদেরঅ তারা আগর গাছ কাটার ক্ষেত্রে এ সকল নীতিমালা সহজ করার দাবি জানান।
অপরদিকে আগর ব্যবসায়ীরা জানান, আগর থেকে অতি মূল্যবান সুগন্ধি তৈল উৎপন্ন হয়। বিদেশে যার যতেষ্ঠ চাহিদা রয়েছে। এক লিটার আগর তেল বিদেশে ৫-৭ লাখ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আগর তেল ও আগর গাছের কাঠের টুকরো দুবাই, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ, ভারত ও সিঙ্গাপুরে অতি উচ্চমূল্যে বিক্রি হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইদানিং আগর ক্লাস্টারে সহজ শর্তে ঋণ দিতে সংশিস্নষ্ট এলাকার ব্যাংকগুলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিদের্শনা দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে এনসিসি ব্যাংক স্থানীয়ভাবে বিনিয়োগে ব্যবসায়ীদের উৎসাহ দেখাচ্ছে।আগর ব্যবসায়ী আব্দুল করিম, ইমান উদ্দিন, কবির আহমদ, বদরম্নল ইসলাম, আব্দুল জলিল, হোসেন আহমদ, তৈয়বুর রহমান ও আব্দুস সহিদ জানান, ভারত যেভাবে বিদেশ থেকে আগরের কাঁচামাল আমদানি করে থাকে। সেইভাবে বাংলাদেশ বিদেশ থেকে আগরের কাঁচামাল আমদানির সুযোগ পেলে দেশীয় কাঁচামালের সংমিশ্রণে যে তেল উৎপাদন করা যাবে তা হবে অত্যনত্ম উন্নত এবং আনত্মর্জাতিক মানের বলে তা বিদেশে রফতানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব।