সৌদি শ্রমবাজার : বাংলাদেশের ক্ষতিতে পাকিস্তানের লাভ

ডেস্ক রিপোর্ট : সোদি আরবের শ্রমবাজার হাতছাড়া করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বিগত বছরগুলোতে দেশটিতে বাংলাদেশি শ্রমিক নেয়া হয়নি বললেই চলে। আর এই শূন্যতা পূরণ করে অন্যতম এই শ্রমবাজারটি দখলে নিচ্ছে পাকিস্তান।উপসাগরীয় অঞ্চলে সংখ্যার দিক দিয়ে সবচেয়ে বেশি (যদিও আনুপাতিক দিক দিয়ে নয়) বিদেশি শ্রমিক নিয়োগকারী দেশ হচ্ছে সৌদি আরব। ১ কোটি ৬০ লাখ জনসংখ্যার দেশটিতে প্রায় ৯০ লাখ বৈধ শ্রমিক রয়েছে এবং পাশাপাশি অবৈধ শ্রমিক রয়েছে আরও কয়েক লাখ।দক্ষিণ এশিয়ার তিনটি বড় শ্রমিক রপ্তানিকারক দেশ হতে ঠিক কি পরিমাণ শ্রমিকের প্রতি বছর সৌদি আরবে ডাক পড়ে তা সুনির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয়। ভারত জানায়, সৌদি আরবে তাদের ১৫ লাখ শ্রমিক রয়েছে; পাকিস্তানও একই সংখ্যক দাবি করে। আর ২৫ লাখ শ্রমিক সৌদি আরবে কাজ করে বলে দাবি করে আসছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের জন্য সৌদি আরবই সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার। (ভারত অবশ্য সৌদি আরবের চেয়ে বরং আমেরিকা ও সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকেই তার শ্রমিকদের দ্বারা বেশি অর্থ উপার্জন করে থাকে)।
গত অর্থ বছরে ৩৭০ কোটি ডলার বা ২ হাজার ১৬০ কোটি টাকা সমপরিমাণ বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান সৌদি আরব থেকে রেমিটেন্স হিসেবে পেয়েছে। এটি তাদের দাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে অর্থনৈতিক সহায়তা হিসেবে পাওয়া টাকার পরিমাণের চেয়ে অনেক বেশি।
এমনকি উভয় দেশের মোট জাতীয় রেমিটেন্সের ক্ষেত্রে সৌদি আরবে নিযুক্ত শ্রমিকদের পাঠানো টাকার অনুপাতও প্রায় সমান- বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের যথাক্রমে ২৯ শতাংশ ও ২৮ শতাংশ। তবে পরিস্থিতি এখন পাল্টে গেছে। আগে যেখানে পাকিস্তানি এবং বাংলাদেশি শ্রমিকদের মধ্যে একটা ভারসাম্য বিরাজ করতো সেখানে এখন একটা অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে পকিস্তান যতোটা লাভবান হয়েছে বাংলাদেশ ঠিক ততোটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
পরিস্থিতি অনুকূলে থাকলে ২০০৯ সাল বাংলাদেশ আমেরিকার আইওয়া অঙ্গরাজ্যের ডেস ময়েন্সে যত সংখ্যক লোক বাস করে তার সমপরিমাণ লোককে সৌদি আরবে চাকরি করার জন্য পাঠাতে পারতো।
এমনকি পরিস্থিতি অনুকূলে না থাকলেও বছরে বেলজিয়ামের মধ্যযুগীয় বাণিজ্যিক রাজধানী ব্রুজেসের জনসংখ্যার সমপরিমাণ লোক বাংলাদেশ থেকে চাকরি করার জন্য এবং দেশে রেমিটেন্স পাঠানোর জন্য সৌদি আরবে পাড়ি জমাতো। কিন্তু সেদিন আর নেই। ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ প্রতি বছর গড়ে মাত্র ১৪ হাজার ৫০০ জন করে শ্রমিক সৌদি আরবে পাঠিয়েছে যা গ্রিনল্যান্ডের রাজধানী নুকে বসবাসকারী জনসংখ্যার চেয়েও কম। শ্রমিক রপ্তানির হারে এ পতনের ফলে বাংলাদেশ রেমিটেন্সের ক্ষেত্রেই শুধু ২০ কোটি ডলার বা ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা হারাচ্ছে। অন্যদিকে, পাকিস্তান তার শ্রমিক রপ্তানির ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বগতিতে রয়েছে। বাংলাদেশের যে হারে কমছে, ঠিক সে হারে পাকিস্তানের বাড়ছে। সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী শুধু ২০১১ সালেই ২ লাখ ২০ হাজার পাকিস্তানি সৌদি আরবে গেছে। যে কোনো কারণেই হোক, সৌদি আরবের শ্রমিক আমদানিতে পছন্দের তালিকা থেকে বাংলাদেশের পতন ঘটেছে। তবে গত মাসে সৌদি আরব বাংলাদেশ থেকে পুনরায় আগের মত শ্রমিক নেয়ার বিষয়টি বিবেচনা করে দেখছে বলে শোনা যায়। কিন্তু সত্যিকার অর্থে কেউই মনে করে না যে সেটা ঘটবে।
বাংলাদেশে তাদের ইসলামি রাজনীতির নেতৃত্বে থাকা জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের ফাঁসি দেয়ার বিষয়টি সৌদি আরব নীরবেই অনুমোদন দেয়নি।
এমনকি এক প্রকার অনিচ্ছাকৃতভাবেই এবং শুধুমাত্র ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবের মুত্যুর পরই সৌদি আরব বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশকে পাকিস্তান থেকে স্বাধীন করার জন্য শেখ মুজিব তার দেশের লোকজন দ্বারা সম্মানিত।
শেখ মুজিবের মৃত্যুর পর ধর্মভিত্তিক দলগুলোর রাজনীতি করার রাস্তা পরিস্কার হয়ে যায় যা এর আগে ১৯৭২ সালের সংবিধান দ্বারা নিষিদ্ধ ছিল। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হসিনা, যিনি শেখ মুজিবের কন্যা, তিনি সুস্পষ্ঠভাবে একটি পরিষ্কার ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান ফিরিয়ে এনেছেন যার অধীনে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির আর কোনো সুযোগ নেই। অবশ্য গত ৭ মার্চ বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জামায়াতে ইসলামীকে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে আখ্যা করে বিভিন্ন দেশের কুটনীতিকদের কাছে যে বার্তা পাঠিয়েছে সেটাও নিশ্চয়ই সৌদিদের নজর এড়িয়ে যায়নি। (তার কার্যালয় থেকে ওই বার্তা একই দিনে সাংবাদমাধ্যমেও পাঠানো হয়)। এদিকে শেখ হাসিনার সরকার চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করবে কিনা তার হিসেবও কষছে।
মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আরেকটি ঘটনা আরব সাগর পাড়ি দিয়ে দেশান্তরের শতবর্ষী এ প্রথার মাঝে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। ২০১১ সালে একজন মিশরীয় নিরাপত্তা রক্ষীকে হত্যা করে এক সশস্ত্র ডাকাতির ঘটনায় ৮ বাংলাদেশিকে প্রকাশ্যে শিরশ্ছেদ করেছিল সৌদি আরব। (এটা কখনো মনে করার সুযোগ নেই, ২০১২ সালে এক দ্রুত বিচার আদালত ঢাকায় নিযুক্ত এক সৌদি কুটনীতিকের হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকায় ৫ বংলাদেশিকে ফাঁসি ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেয়। কারণ দ্রুত বিচার আদালতের ওই রায় কার্যকর ‘চোখের বদলে চোখ নীতিতেও’ এটার সমান প্রতীয়মান হবে হবে না।) যদি জামায়াতের সব নেতাই চলমান যুদ্ধাপরাধ আদালতে দোষী সাব্যস্ত হয়, দেশের একটা অংশ যেমনটি আশা করছে, তাদেরকে এ বছরই ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়ে দেয়া হতে পারে। সৌদি আরবের সাথে সম্পর্ক এখন যে পর্যায়ে আছে, তা যদি একই রকম থাকে তাহলে শ্রমিক রপ্তানির জন্য বাংলাদেশকে অবশ্যই বিকল্প বাজারের অনুসন্ধান জারি রাখতে হবে। এ সুযোগে যদি পাকিস্তানের রেমিটেন্সের ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটে যায় তাহলে সেটাই ভালো হবে, কারণ এর মধ্য দিয়ে সৌদিদের প্রতিশোধের বিষয়টি আরও পরিষ্কার হয়