বিচারপতি নাজমুন আরা মৌলভীবাজারে মেয়ে
নিউজ ডেস্ক : বিভিন্ন অঙ্গনে নারীর অগ্রগতির মাঝেই এই প্রথমবারের মতো দেশের সর্বোচ্চ আদালতে বিচারিক কাজের নেতৃত্ব পেয়েছেন একজন নারী, যার নেতৃত্বে অনেক মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হবে। গতকাল সোমবার সুপ্রিম কোর্টের দুই নম্বর বিচারকে মৌলভীবাজার জেলার কৃতি এই নারী বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানার নেতৃত্বে আপিল বিভাগের নবগঠিত দ্বিতীয় বেঞ্চের বিচারিক কার্যক্রম শুরু হয়।
সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার একেএম শামসুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, নাজমুন আরা সুলতানা বাংলাদেশের প্রথম নারী বিচারপতি। প্রথম নারী হিসাবে তিনিই সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে কোনো বেঞ্চের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
নতুন চার বিচারপতি নিয়োগের পর মামলা নিষ্পত্তিতে গতি আনতে প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন রোববার সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে দুটি বেঞ্চ গঠন করে দেন।
প্রধান বিচারপতি নেতৃত্বাধীন প্রথম বেঞ্চের অন্য পাঁচ বিচারপতি হলেন, বিচারপতি এস কে সিনহা, বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি ছিদ্দিকুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী।
এই বেঞ্চের বিচারপতিরা সুপ্রিম কোর্টের এক নম্বর বিচারকে বিচার কাজ পরিচালনা করবেন। আর বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা নেতৃত্বে সুনামগঞ্জের ছাতকের কৃতি সন্তান বিচারপতি মো. ইমান আলী, বিচারপতি মোহাম্মদ আনোয়ারুল হক ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর বেঞ্চ বিচার কাজ পরিচালনা করবেন দুই নম্বর বিচারক।ে
আপিল বিভাগে এতোদিন একটি বেঞ্চই বিচারকাজ পরিচালনা করে আসছিল। একটি বেঞ্চ থাকলে সুপ্রিম কোর্টের এক নম্বর বিচারকে আপিল বিভাগের বিচারপতিরা বিচার কাজ পরিচালনা করেন। কাজেই দ্বিতীয় বিচারকটি ফাঁকাই পড়ে থাকত এতোদিন। অতীতে বিভিন্ন সময়ে বিচারপতিদের সংখ্যা বেশি থাকলে মামলার চাপ কমানো বা গুরুত্বপূর্ণ মামলার শুনানির জন্য আপিল বিভাগের একাধিক বেঞ্চ আলাদা বিচারকে কাজ করেছে। বিচারপতি খায়রুলের হকের সময়ে সর্বশেষ আপিল বিভাগে পৃথক বেঞ্চ দেখা গেছে।
বর্তমান প্রধান বিচারপতি অবসরে যাওয়ার আড়াই বছর পর ২০১৭ সালের ৮ জুলাই অবসরে যাবেন পেশাগত জীবনের প্রায় পুরো সময় বিভিন্ন স্তরে প্রথম নারী বিচারক হিসাবে দায়িত্ব পালনকারী নাজমুন আরা সুলতানা। প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনের ২০১৫ সালের ১৭ জানুয়ারি অবসরে যাওয়ার কথা রয়েছে।
১৯৫০ সালের ৮ জুলাই মৌলভীবাজারে জন্মগ্রহণ করেন নাজমুন আরা সুলতানা। শৈশবেই বাবা চৌধুরী আবুল কাশেম মঈনুদ্দীন হারান তিনি। তিন বোন ও দুই ভাইয়ের সঙ্গে শৈশব-কৈশোর কেটেছে মা বেগম রশীদা সুলতানা দীনের কর্মস্থল ময়মনসিংহে। রশীদা সুলতানা ছিলেন ময়মনসিংহের রাধাসুন্দরী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক।
এই শহরের বিদ্যাময়ী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৬৫ সালে এসএসসি, ১৯৬৭ সালে মুমিনুন্নেসা উইমেন্স কলেজ থেকে এইচএসসি এবং ১৯৬৯ সালে আনন্দ মোহন কলেজ থেকে বিএসসি ডিগ্রি লাভ করেন নাজমুন আরা সুলতানা। তার বাবার স্বপ্ন ছিল, সন্তানদের মধ্যে অন্তত একজন আইনজীবী হবেন। সেই স্বপ্ন পূরণে নাজমুন আরা বিএসসি পাসের পর আইন পড়তে ভর্তি হন মোমেনশাহী ল কলেজে। সেখান থেকেই ১৯৭২ সালে এলএলবি ডিগ্রি পান।
ওই বছরেরই জুলাই মাসে ময়মনসিংহ জেলা আদালতে আইনজীবী হিসাবে কাজ শুরু করেন এই নারী। শুরুর দিকে ‘মেয়ে উকিল’ হিসাবে নানা রকম তাচ্ছিল্য আর বিড়ম্বনা পোহাতে হলেও থেমে থাকেননি তিনি। আইনজীবী হিসাবে নাজমুন আরার পেশাগত জীবন শুরুর সেই সময়ে নারীর বিচারক হওয়ার সুযোগ ছিল না। রাষ্ট্রীয় সেই বাধা সরিয়ে নেয়া হয় ১৯৭৪ সালে।
এরপর বিসিএস পরীায় অংশ নিয়ে ১৯৭৫ সালের ২০ ডিসেম্বর মুনসেফ হিসেবে বিচার বিভাগে যোগ দেন নাজমুন আরা সুলতানা। বিচারকের আসনে সেই প্রথম কোনো নারীকে পায় বাংলাদেশ। ১৯৯০ সালের ২০ ডিসেম্বর জেলা ও দায়রা জজ হন তিনি।
তারও এক দশক পর ২০০০ সালের ২৮ মে হাইকোর্টে অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান নাজমুন আরা সুলতানা। অতিরিক্ত বিচারকের দুই মেয়াদ শেষে যথানিয়মে স্থায়ী হন। আর আপিল বিভাগের বিচারপতি হিসাবে শপথ নেন ২০১১ সালের ২৩ ফেব্র“য়ারি।
ফতোয়াকে অবৈধ ঘোষণা করে দেয়া হাই কোর্টের আলোচিত রায় প্রদানকারী দ্বৈত বেঞ্চের একজন ছিলেন নাজমুন আরা সুলতানা। ২০০১ সালের ১ জানুয়ারি ওই রায়ের সময় তার সঙ্গে জ্যেষ্ঠ বিচারপতি হিসাবে ছিলেন বিচারপতি গোলাম রাব্বানী।
সেনানিবাসে খালেদা জিয়ার বাড়ি নিয়ে মামলা, বিএনপির আমলে বাদ পড়া ১০ বিচারপতির মামলা, আপিল বিভাগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মামলাতেও তিনি বিচারকের দায়িত্ব পালন করেন।