কমলগঞ্জের ছয়চিরি দিঘীর পাড়ে প্রাচীন ঐতিহ্য লালিত সর্ববৃহৎ চড়ক পূজা

কমলগঞ্জ প্রতিনিধি : প্রায় ২০০ বছরের অধিক সময় ধরে প্রাচীন ঐতিহ্য লালিত মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার ১নং রহিমপুর ইউনিয়নের ছয়চিরি দিঘীর পাড়ে প্রতিবছরের ন্যায় চৈত্র সংক্রান্তিতে ৩দিন ব্যাপী অনুষ্ঠিত হবে সর্ববৃহৎ চড়ক পূজা উৎসব।
জানা যায়, চড়ক পূজা উৎসবের ১০/১২ দিন পূর্ব থেকে বিভিন্ন এলাকার পূজারীর মধ্যে ৪০/৫০ জন সন্যাস ধর্মে দীক্ষিত হয়ে গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে শিব-গৌরী সাজিয়ে নৃত্যগীত সহকারে ভিক্ষাবৃত্তিতে অংশ নেয়। এ ক’দিন তারা পবিত্রতার সহিত সন্যাস ব্রত পালন করে নিরামিষ ভোজি এবং সারাদিন উপবাস পালন করে। চড়ক পূজার ২ দিন পূর্বে পূজারীরা শ্মশানে গিয়ে পূজা অর্চনা করেন ও শেষে গৌরীর বিয়ে, গৌরী নাচ ও বিভিন্ন গান গেয়ে ঢাকের বাজনায় সরগরম করে গোটা এলাকা। ছয়চিরি দিঘীর পাড়ে ভক্তরা নৃত্য করার জন্য কলাগাছ ও বাঁশের খুটি বেষ্টিত মন্ডলী তৈরী করে।
আগামী ১৩ এপ্রিল শনিবার নিশি রাতে তান্ত্রিক মন্ত্র ধারা কাচ পড়া দিয়ে জলন্ত ছাইয়ের উপর একজন ভক্ত কালী সেজে নৃত্যে মেতে উঠবে। অন্য ভক্তগণ নৃত্যের তালে তালে, ছন্দে ছন্দে ঢোলক, কাশিসহ বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র বাজাবেন। এসময় দর্শনার্থীরা জয়ধ্বনি ও নারী কন্ঠে হুলুদ ধ্বনি দিতে থাকনে। জ্বলন্ত আগুনের মধ্যে এই ‘কালীনাচ’ অত্যন্ত আকর্ষনীয় এবং তান্ত্রিক মন্ত্র দিয়ে ৭টি বলিছেদ (লম্বা দা) এর উপর শিব শয্যা করেন। শিবের বুকের উপর উঠে কালী ভয়ানক এক অদ্ভুত রূপ ধারন করেন। এসময় উপস্থিত দর্শনার্থীদের মধ্যে আতঙ্কিত ভাব থাকে। কালীকাঁচ শেষ হওয়ার পরে ১৪ এপ্রিল রবিবার সকালে পূজারীরা পূজা করে পান বাটা দিয়ে চড়ক গাছকে নিমন্ত্রণ জানানো হবে। তখন পার্শ্ববর্তী ঐতিহাসিক ছয়চিরি দিঘী থেকে ভেসে উছবে প্রায় ১০০ ফুট লম্বা চড়ক গাছ। এ গাছের চুড়া থেকে মাচা পর্যন্ত চারটি পাখার মতো করে বাধা হয় চারটি মোটা বাঁশ এবং তাতে যুক্ত করা হয় মোটা লম্বা রশি। (আগের বছর উৎসব শেষে এই দিঘীতে ডুবিয়ে রাখা হয়ে ছিল চড়ক গাছ)। দিঘীর পাড়ে গর্ত খুড়ে সোজা এবং খাড়া করে পোঁতা হয় এ গাছ।
ঐদিন দপুর থেকে নারী পুরুষ দর্শনার্থীদের বিশাল সমাগম ঘটে। কারণ এইদিন পূজারীরা বিভিন্ন কর্মসূচী নিয়ে থাকে। বিকেল বেলা ভক্তরা কলা গাছ ও বাঁশের মন্ডলীতে বিশাল দা (বলিছেদ) দিয়ে নৃত্য, শিবের নৃত্য ও কালীর নৃত্য দেখানো হয়। নৃত্য শেষে ঐতিহাসিক ছয়চিরি দিঘীতে ভক্তরা স্নান করে ভক্তদেরকে লোহার শিকড় শরীরের বিভিন্ন অংশে পিষ্ট (গাঁথা) করা হয়। বিশেষ করে জিহ্নবা ও গলায় গেঁথে দেয়া হয়। নৃত্যের তালে তালে চড়ক গাছ এবং মন্ডপ ঘর ঘুরানো হয়। এই দৃশ্য দেখে দর্শনার্থীরা আঁতকে উঠে। (অনেকেই মন্তব্য করে শরীরের সমান্য স্থানে ক্ষত হলে সহ্য করা যায় না। কিন্তু একজন মানুষের শরীরে লোহার শিকল গেঁথে দেয়া হয়)। সবাই দেবতার পূজা-অর্চনা শেষে অপরাহ্নে মূল সন্যাসী ৪ জন ভক্তের (জ্যান্ত মানুষের) পিঠে লোহার দু’টি করে বিশাল আকৃতির বড়শি গেঁথে রশিতে বেঁধে ঝুলিয়ে চড়ক গাছে ঘুরানো হয়। এ সময়ে দর্শনার্থীদের অনেকে বাতাসা আর কলা উপরের দিকে উড়িয়ে দেন আর তা দর্শনার্থীরা তা কুড়িয়ে নেন।
১৫ এপ্রিল সোমবার ফেরা চড়ক পূজা অনুষ্ঠিত হয়। ওই দিন দেবতার পূজা অর্চনা করা হয় এবং বড়শি গেঁথে চড়ক গাছ ঘুরানো হয়। ঐতিহ্যবাহী ছয়চিরি দিঘীর চার পাড়ের মধ্যে দিঘীর পূর্বপাড়ে ১টি, উত্তর পাড়ে ১টি এবং দক্ষিন পাড়ে ২টি চড়ক গাছ স্থাপন করে পূজা অনুষ্ঠিত হয়। তান্ত্রিক মন্ত্রের ধারা বিভিন্ন অলৌকিক ধর্মীয় কর্মসূচী উপভোগ করার জন্য প্রতি বছর দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে নারী- পুরুষ, ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে লাখো দর্শনার্থীর উপস্থিতি লক্ষনীয় থাকে। চড়ক পূজা উপলক্ষে এক বিশাল মেলা ছয়চিরি দিঘীর পূর্ব ও দক্ষিণ পাশে বসবে। এ মেলায় বিভিন্ন রকমারী জিনিসপত্রের সয়লাব থাকবে। এই বিশাল সর্ব বৃহৎ চড়ক পূজায় আসতে হলে মৌলভীবাজার জেলা শহর থেকে শমশেরনগর রোডে প্রায় ১৩ কিঃ মিঃ দক্ষিণে বাবুরবাজার নামক স্থান থেকে ১ কিঃমিঃ পশ্চিমে ছয়চিরিদিঘীরপাড়। মৌলভীবাজার থেকে সিএনজি যোগে রিজার্ভ ১০০/১২০ টাকা ভাড়া লাগবে। অথবা শ্রীমঙ্গল রেল ষ্টেশন থেকে রিজার্ভ সিএনজি যোগে আসা যায়। কমলগঞ্জ সদর হয়ে মুন্সীবাজার থেকে ছয়চিরিদিঘীর পাড়। ভাড়া ২৫০ টাকা। এছাড়াও শমশেরনগর রেল ষ্টেশন থেকে ১০০ টাকায় সিএনজি যোগে আসা যায়।