পহেলা বৈশাখ তুমি কার…?

এম জে এইচ জামিল : কাল তো এমনিই! বয়ে চলে স্রোতের বেগে। আর পেছনে রেখে যায় ঝরা াতার মত সফলতা কিংবা ব্যর্থতা, সেই সাথে আনন্দ কিংবা বেদনা-বিষাদের গুঞ্জরণ। যে গুঞ্জরণে আমাদেরকে ক্ষণিকের জন্য হলেও পেছনে তাকাতে হয়। ফেলে আসা প্রতিটি মুহুর্তই অতীত। আর অতীত তো কেবল আশ্রয় খোঁজে ইতিহাসের কোমল কিংবা অগ্নিময় বর্ণগুচ্ছের ভেতর। এটাই কালের অনিবার্য পরিণতি। তাই পহেলা বৈশাখ বাংলা বর্ষবরণের দিনে সবাইকে বৈশাখী শুভেচ্ছা। শুভ নববর্ষ।
১৪ এপ্রিল মহাসমারোহে ও মহাধুমধামের সহিত পালিত হতে যাচ্ছে পহেলা বৈশাখ শুভ নববর্ষ। সেদিন একদিনের বাঙালী সাজার নমুনা বিবেকবান সুনাগরিকদেরকে আনেকাংশে মর্মাহত করে। যে ছেলে-মেয়েগুলো ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে কিংবা করছে তাদেরকে প্রশ্ন করা হলে এখনও শুদ্ধভাবে বাংলা বার মাসের নামই বলতে পারবে কি না সন্দেহই থেকে যায়। আর তথাকথিত কিছু সুশীল সমাজ (?) ও ভিনদেশ থেকে আমদানী করা বস্তাপচা অপসংস্কৃতির ধারক-বাহক বুদ্ধিজীবিরা নীতি নৈতিকতা ও মূল্যবোধ বেমালুম ভুলে বিজাতীয় সংস্কৃতির জোয়ারে গা ভাসিয়ে দিয়ে যুবসমাজকে নিজস্ব সংস্কৃতি থেকে দুরে ঠেলে দেয়ার ষড়যন্ত্র করছেন।
২০১০ সালের পহেলা বৈশাখের স্মৃতিটা মানে হলে আনেক বিবেকবান মানুষও আাশাহত হবে। সেইদিন দেশ জুড়ে চলছিল হাহাকার। তখন পানিতে তলিয়ে গিয়েছিল বাঙ্গালী বৈশাখী সংস্কৃতির খোরাক অসহায় কৃষকদের সোনালী ফসলের জমি। যা দিয়ে মূলত পালন করা হত নবান্ন উৎসব। কিন্তু অসহায় কৃষকের চোখের জল ও পাহাড়ী ঢলের পানিতে মিশে একাকার হয়ে গেলেও তা দেখার কেউ ছিলনা। কৃষক যদি না বাঁচে ধান যদি উৎপন্ন না হয় তাহলে কিসের বৈশাখ আর কিসের আনন্দ। এই প্রশ্ন শত শত দেশপ্রেমিক ও বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী আদর্শে অনুপ্রাণিত নাগরিকের। মনের অজান্তেই তখন বলে ওঠতে বাধ্য হই পহেলা বৈশাখ তুমি কার?
বৈশাখ এলেও এখনও কৃষকের গোলায় উঠেনি সোনালী ধান। এবছরের অনাবৃষ্টি এবং শিলাবৃষ্টিতে নতুন ধান তোলা নিয়ে শংকিত দেশের গোটা কৃষক সমাজ। এছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে হাওর রক্ষা বাধ নির্মানে ত্রুটি এবং কোটি কোটি টাকা লোপাটের সচিত্র সংবাদ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এ নিয়ে আমাদের কথিত যুব সমাজের কোন মাথা ব্যাথা পরিলক্ষিত হয়নি। এই অবস্থায় শহরে বর্ষবরনের নামে এত উচ্ছাসের সার্থকতা কোথায়। আমাদের অবশ্যই সে কথা উপলব্দি করতে হবে । অন্যথায় আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম আমাদের কোন দিন ক্ষমা করবেনা।
আর পহেলা বৈশাখের অশ্লীলতা ও বেহায়াপনা বর্তমানে এতটা বেড়ে গিয়েছে যে ইউরোপ ও পাশ্চাত্য সঙস্কৃতিকেও হার মানায় বা বাংলার কেউ যদি এর বিরুদ্ধে কোন মন্তব্য করে তাহলে তাকে সস্তা উপাধি মৌলবাদী পদকে ভূষিত করতে আমার দেশের তথাকথিত বুদ্ধিজীবি ও সুশীল সমাজকে মোটেও বেগ পেতে হয় না। সেকুলারিষ্টরা পহেলা বৈশাখ সম্বন্ধে বলে থাকেন এটা আমার দেশের সকল ধর্মের মানুষের ঐক্যমতের সংস্কৃতি। এখানে ধর্ম কোন ফ্যাক্টর নয়। কিন্তু প্রশ্ন জাগে ঐ সমস্ত বুদ্ধিজীবীরা এত মেধার রাজ্য বিচরণ করার পরও বৈশাখ কিংবা বাংলা সনের আগমনের ইতিহাস সম্পর্কে প্রয়োজনীয় জ্ঞান আহরণ করার চেষ্টা করছেন বা করেছেন কিনা। আসুন পহেলা বৈশাখ সম্পর্কে কিছু জানার চেষ্টা করি।
মানুষ তার প্রয়োজনে সময় ও কাল গননায় এই যে রীতি আবিষ্কার করে নিয়েছে এটি মানব জাতির আদিমকালের প্রবৃর্ত্তি এবং মানুষের সহজাত সংস্কৃতির অংশ। পৃথিবীর দেশে দেশে জাতিতে জাতিতে সন ও বছর গননার নানা পন্থা আবিস্কৃত হয়েছে। পৃথিবীতে যত দেশে যত সন আছে সবগুলোরই ১২ মাসে বছর। অবশ্য সৌরমাসভিত্তিক এবং চান্দ্রমাসভিত্তিক গণনার ভিন্নতায় এসব সনের পরিধিগত বেশ-কমও রয়েছে। সব গণনার বিশ্বজনীন সংস্কৃতির পথ ধরেই আমাদের বাংলাদেশেও নানা যুগে নানা সন প্রবর্তিত হয়েছে। প্রাচীন শক সনের পথ ধরে এখানে প্রবর্তিত হয়েছে সম্বৎ, মঘী সন, নেপাল, সম্বৎ, ত্রিপুরাব্দ, লক্ষণ সম্বৎ, পরগণাতি সন, শাহুর সন, হিজরি সন, ঈসায়ী বা খ্রিষ্টীয় সন, বাংলা সন, জালালি সন ইত্যাদি। এর কোন কোনটা সৌরবর্ষে আবার কোন কোনটা চান্দ্রবর্ষে গণনা করা হয়ে থাকে।
বাংলা সন প্রবর্তিত হয়েছে সম্রাট আকবরের (১৫৫৬-১৬০৫) আমলে। সম্রাট আকবরের সিংহাসন আরোহনের বছর ৯৬৩ হিজরী (১৫৫৬ ঈসায়ী) সনকে শুরুর বছর ধরে ফসলি সন নামে যে সন প্রবর্তন করা হয়। কালক্রমে তাই বাংলাদেশে বাংলা সন নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। মূলত জমির খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে এ সন প্রবর্তন করা হয়। এর আগে এদেশের দেশীয় সন হিসেবে শকাব্দের প্রচলন থাকলেও রাষ্ট্রীয়ভাবে হিজরি সন চালু ছিল গোটা ভারতবর্ষে। আর একারণেই হিজরি সনকে ভিত্তি বছর ধরে এ বাংলা সনের প্রবর্তন করা হয়। অন্যদিকে এ সনের মাসের নামগুলো নেয়া হয় শকাব্দ থেকে। এভাবে দেখা যায় সনটি প্রবর্তনে প্রধান দুটি জাতি অর্থাৎ হিন্দু এবং ইসলাম উভয় ধর্মের একটি প্রভাব সনটির উপর পড়েছে। এক্ষেত্রে হিজরী সনকে যদি আমরা বাংলা সনের মায়ের মর্যাদা দেই তাহলে শকাব্দকে দিতে হয় মামীর মর্যাদা। বাংলা সন ছাড়াও প্রায় সকল সনের ক্ষেত্রে হিন্দু মুসলিমের এই মিলিত স্রোত সনটিকে এমন একটি অবস্থানে এনে দাড় করিয়েছে যা উদার ইসলামী সংস্কৃতির পাশাপাশি বাংলাদেশী সংস্কৃতির সাথেও পুরোপুরি সামঞ্জস্যশীল। কৃষকের জমির খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে এ সন প্রবর্তন করা হয়েছিলো। ফলে সন প্রবর্তনের সময় থেকেই সাধারণ মানুষের সাথে এ সনের পরিচয় ও সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সমাজের সর্বনিম্ন স্তর পর্যন্ত বাংলা সন ব্যবহৃত হবার কারণে মানুষের প্রতিদিনের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার সাথী হয়ে আছে এই সনটি। এই কারণে দেখা যায় বাংলা সনের প্রথম দিনটি অর্থাৎ পহেলা বৈশাখকে নানা আয়োজনের মধ্যে দিয়ে উদযাপন করা হয়ে থাকে।
দুঃখজনক হলেও সত্য, আজ উৎসবের সঙ্গে যুগ পরিবর্তনের ছাপ স্পষ্ট। উৎসবে যেখানে একদা হৃদয় আবেগের প্রাধান্য ছিল, ছিল প্রীতিময় আন্তরিকতা। আজ কৃত্রিমতা তাকে গ্রাস করে ফেলেছে। যেখানে হৃদয়হীন আচার অনুষ্ঠানের মাতামাতি। চোখ ঝলসানো চাকচিক্য আজ উৎসবের বৈশিষ্ট্যে। নাগরিক সভ্যতার যান্ত্রিকতা আজ আমাদের হৃদয়ের ঐশ্বর্য্য লুন্ঠন করেছে। নির্বাসিত করেছে, শুস্ক নিষপ্রাণ জড় জগতে। উৎসবে তাই আজ আমাদের হৃদয়-দৈন্যের নগ্নতা। উৎসবের মহতি কল্যাণী রূপটিই আজ আমাদের কাছে অনুদ্ভাষিত। নববর্ষের উৎসব অনুষ্ঠানেও আজ আন্তরিক প্রীতির অনেক অভাব। মাইকে চটুল গানের বাড়াবাড়ি। সেখানেও উল্লাস মত্ততার চিত্র। যেখানে আমাদের হৃদয় সংকুচিত, আমাদের দ্বার রুদ্ধ। বর্ষবরণের উৎসবেও দীবালোকের উজ্জ্বলতা, খাদ্য প্রাচুর্য, আয়োজন বৈচিত্র। সেখানে শুষ্কতা, আমাদের দীনতা আমাদের নির্লজ্জ কৃপণতারই বহিঃপ্রকাশ। তাই আজ এই বর্ষ বন্দনার পূণ্য মুহূর্তে আমাদের মনে রাখতে হবে, সমারোহ, সহকারে অমোদ প্রমোদ করা আমাদের উৎসব কলা কিছুমাত্র চরিতার্থ হয়না। তার মধ্যে সর্বদলের আন্তরিক প্রসন্নতা ও ইচ্ছাটুকু না থাকলেই নয়। নববর্ষে যেন ফিরে পাই আমাদের সেই হৃত গৌরব। আবার যেন আমাদের হৃদয় পরিপূর্ণ হয়ে উঠে আন্তরিক প্রসন্নতা ও কল্যাণকর ইচ্ছার চেতনায়। আবার যেন আমরা বর্ষারম্ভের উৎসবে খুঁজে পাই মনুষ্যত্ত্বের শক্তি অনুভব করার মহত্ত্ব। আজ নববর্ষ উৎসব সত্যের গৌরবে, প্রেমের গৌরবে, নির্ভিক চিত্তের গৌরবে উদ্ভাসিত হয়ে উঠুক।
একটি কুচক্রী মহল পহেলা বৈশাখকে এক উদ্ভট সংস্কৃতিতে পরিণত করার হীন প্রয়াসে লিপ্ত রয়েছে। ইসলামী উদার সংস্কৃতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে। সম্পূর্ণ হিন্দু সংস্কৃতি তথা মূর্তি পূজার সংস্কৃতিতে পরিণত করে ফেলেছে। যা আমাদের ধর্মীয় মূল্যবোধকে নানাভাবে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলেছে। যেখানে কৃষকের চোখে জল সেখানে আবার কিসের উন্মাদনা। এ বুঝটুকু যতদিন না এ জাতি উপলব্ধি করতে পারবে ততদিন এ জাতির ভাগ্য পরিবর্তন কোনভাবে সম্ভব হবে না। বৈশাখের নামে বেহায়াপনা ও অশ্লীলতার প্রভাবে যুব সমাজের মারাত্মক অবক্ষয় জাতির জন্য ধ্বংস যজ্ঞের এক অশনি সংকেত। পরিশেষে বলতে চাই গাছের গোড়া কেটে আগায় যত পানি দেন এবং পরিচর্যা করেন না কেন এতে ক্ষতি না হোক লাভের আশা নেই।
আসুন দেশের দিকে দেশের মানুষের দিকে তাকাই। অসহায় কৃষকের মুখে হাসি ফোটাতে পারলে বার মাসই আমরা সুখে থাকতে পারব। আর এ পদক্ষেপ আমাদেরকে একদিনের নয়, চিরদিনের বাঙালী হতে সহায়ক হবে।
(লেখক : সাংবাদিক ও সংগঠক, সেক্রেটারী : আমার দেশ পাঠকমেলা, সিলেট)