ইলিয়াস নিখোঁজের এক বছর আজ

আলী শিপন, বিশ্বনাথ : বুক ভরা আশা নিয়ে এখনও ছেলের অপেক্ষায় আছেন নিখোঁজ বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীর মাতা সূর্য্যবান বিবি (৮০)। আগের মত কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেও চোঁখ দিয়ে পানি আসছে না। ছেলের জন্য কাঁদতে কাঁদতে চোঁখের পানি শুকিয়ে গেছে। তারপর ছেলের জন্য অপেক্ষার প্রহর গুণছেন। কবে ঘরে আসবে আদরের ছেলে ইলিয়াস আলী। সূর্য্যবান বিবির চার ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে ইলিয়াস আলী চর্তুথ। ছেলেদের মধ্যে ইলিয়াস আলী দ্বিতীয়। তিনি ছিলেন সূর্য্যবান বিবির আদরের ধন। ইলিয়াস আলীও মাকে খুব ভাল বাসতেন। রাজনীতির কারনে ব্যস্ত থাকলেও সময়ে খোঁজ নিতেন মাতা সূর্যবান বিবির। সুযোগ পেলে ছুটে যেতেন গ্রামের বাড়ির বিশ্বনাথে রামধানায়। সর্ব শেষ গত ১৬ এপ্রিল বাড়িতে গিয়েছিলেন ইলিয়াস আলী। প্রতিবার বাড়িতে গেলে বিদায় বেলায় সূর্যবান বিবি তাকে আদার করেন,মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। কিন্তু শেষবার ইলিয়াস আলীকে সেভাবে বিদায় দিতে পারেননি তিনি। এ দিনটি ঘটে সেই দুঃস্বপ্নের ঘটনাটা। তাই ১৭ তারিখটা যেন বিভাষিকাময় হয়ে গেছে সূর্যবান বিবির কাছে। কারণ, গত ১৭ এপ্রিল ঢাকা থেকে নিখোঁজ হন তার আদরের ছেলে বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী। কবে শেষ হবে ইলিয়াস আলীর মায়ের প্রতিক্ষার প্রহর? ঘরে বসে পথ পানে নির্বাক চেয়ে থাকা? ইলিয়াস আলীর স্নেহময়ী মায়ের মুখে কখন ফুটবে হাসি? নিখোঁজের সাত মাস “নিখোঁজ রহস্যে”র কুলকিনার না হওয়ায় একেবারেই ভেঙ্গে পড়েছেন ইলিয়াস আলীর মা সূর্যবান বিবি।
গতকাল সকালে বিশ্বনাথে নিখোঁজ ইলিয়াস আলীর নিজ রামধানা গ্রামের বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, বাড়িতে আগের মত মানুষ জনের আনাগোনা নেই। দুই-একজন আসা যাওয়া করছেন। নিখোঁজ ইলিয়াস আলী নেতাকর্মীদের নিয়ে আলাপ-আলোচনা করার জন্য তৈরি করা এক তলা বিশিষ্ট দালান ঘরটি পাঁকা। দরজা-জানালা খোলা থাকলেও একজন মানুষও এ ঘর নেই। বাড়ি চারপাশে নিরবতা। ইলিয়ার আলীর ছোট ভাই আছকির আলী ঢাকা থেকে বাড়িতে আসেন। কিন্তু এখন তিনি বাড়িতে রয়েছেন। যার ফলে দলীয নেতাকর্মী তাঁর সাথে সাক্ষাত করেন।
ইলিয়াস আলীর মা সূর্য্যবান বিবি এ প্রতিবেদক জানান, বাবা তুমি কিতার লাগি আইছো। আর খত ছবি তুলবায় ও খত কথা লেখ বায়। খত সাংবাদিক যে ছবি তুলা নিয়েছেন তার কোন হিসেব নেই। আজ সাত মাস হয়ে গেলে ছেলে মুখের কথা শুনতে পাইনি। সন্তান পাশে না থাকার ব্যথা মায়ই বলতে পারে কত কষ্ট। ছেলের বউ ইলিয়াস আলীর (স্ত্রী) প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করার পর মনের মাঝে অনেক আশা ছিল তিনি ইলিয়াস কে খুজে বের করে আমার বুকে এনে দেবেন। কিন্তু আজ সে আশায় পথে চেয়ে রয়েছি। ছেলের জন্য প্রতিদিন নামাজ পড়ে দোয়া করি। আলাহর ওপর ভরসা করে রয়েছি। তিনি ছেলে কে ফিরিয়ে পাওয়ার জন্য দেশবাসি কে দোয়া করার আহবান জানান।
ইলিয়াস আলীর ছোট ভাই আছকির আলী বলেন, ইলিয়াস আলী মাটি ও মানুষের নেতা। তিনি কোন দিন কারো ক্ষতি করেননি। তিনি সব সময় মানুষের জন্য কিছু করার চেষ্ঠা করেছেন। এই মানুষটিকে কেন গুম করা হলো ? এর উত্তর জনগণ জানতে চায়। আমরা ক্ষমতা প্রতিপত্তি কিছু চাই না। যে কোন মূল্যে ইলিয়াস আলী ও তাঁর গাড়ী চালক আনছার আলীকে অক্ষত এবং সুস্থ অবস্থায় আমাদের মাঝে ফিরে পেতে চাই। এজন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে ইলিয়াস আলী এবং তাঁর গাড়ী চালক আনছার আলীকে অক্ষত অবস্থায় ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য জোরদাবী জানান। ভাইকে ফিরিয়ে পেতে তিনি পরিবারের পক্ষে থেকে সকলে সহযোগিতা চান।
ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসিনা রুশদি লুনা বলেন, দেখতে দেখতে একটি বছর পার হয়ে গেলেও। কিন্তু আজও জানতে পারি স্বামীর কোন সন্ধান। আল্লাহ’র ওপর ভরসা করে রয়েছি।
তিনি বলেন, স্বামী কে ফিরিয়ে পাওয়ার জন্য সব রাজনৈতিক দল, দেশবাসি সহযোগিতা কামনা করেন।
আনসারের মা এখন শয্যাহীন
চাকরি করতেন ঢাকায় বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক নিখোঁজ এম ইলিয়াস আলীর গাড়ির ড্রাইভার হিসেবে। সুযোগ পেলেই ছুটে আসতেন গ্রামের বাড়ি বিশ্বনাথে। একমাত্র সন্তান চাঁদনীকে (৩) দেখার জন্য। বাবা এখন আর আসেন না। অপহরণ, নিখোঁজ বা গুম-হত্যার অর্থ চাঁদনী বুঝতে না পারলেও ছোট চাঁদনী ঠিকই বুঝতে পারে তার বাবা আসছে না। কেবল দু-একটি শব্দ বলতে শেখা চাঁদনীর মুখ থেকে প্রায়ই শোনা যায় ‘আব্বু’। টাকার অভাবে ছোট এ শিশুর দুধ কেনা এখন বন্ধ। এ দিকে আনসারের মা এখন শয্যাশায়ী। আনছার নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে তাঁর চিকিৎসা বন্ধ। আনসার আলীর চাকরির টাকা দিয়েই চলত তাদের পরিবার।
গত বছরের ১৭ এপ্রিল রাতে রাজধানীর বনানী থেকে বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হন। ইলিয়াস আলীর গাড়ির চালক ছিলেন আনসার আলী। গাড়িটি বনানী থেকে উদ্ধার হলেও ঘটনার পর থেকে আনসার আলীও নিখোঁজ। আনসার আলীর স্ত্রী মুক্তা বেগম বলেছেন, যে রাতে তিনি নিখোঁজ হয়েছেন ওই রাত ১১টার দিকে তাদের সাথে আনছার আলীর সর্বশেষ কথা হয়। রাতেই তারা জানতে পেরেছেন ইলিয়াস আলীর সাথে আনসার আলীও নিখোঁজ হয়েছেন।
আনসারের স্ত্রী মুক্তা বেগম জানান, ছুটি পেলে তার স্বামী ছুটে আসতেন গ্রামের বাড়িতে। ছোট্র চাঁদনীকে নিয়েই কাটত তার সময়। দুই বছরের চাঁদনীর মুখ থেকে দু-একটি শব্দ বের হয়। এর মধ্যে একটি হলো ‘আব্বু’। এ ডাক শুনতে আনসার ছিলেন ব্যাকুল। মোবাইল করেও এ ডাকটি শোনার জন্য তিনি দীর্ঘক্ষণ ফোন কানে ধরে রাখতেন। বাবা নিখোঁজ রয়েছেন তা বোঝার বয়স হয়নি চাঁদনীর। কেই তার সামনে বাবার কথা জিজ্ঞেস করলেই সে বলে ওঠে ‘আব্বু’। পরিবারের সদস্যরা বলেন, অভাবের সংসার। আনসারের টাকায়ই সংসার চলত। আনসার নিখোঁজ হওয়ার পর চাল, ডাল তেল কিনতেই ত্রাহি অবস্থা। শিশুটির দুধ কেনার টাকা কোথায় পাবেন। বাবার কত আদরের মেয়ে এখন খাবার না পেয়ে দিন দিন রুগ্ন হয়ে পড়েছে।
দিন রাত বিলাপ করছেন আনসারের মা নুরজাহান বেগম। আনছার আলী নিখোঁজের এক বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি। সেই ১৭ এপ্রিল থেকে এখন পর্যন্ত তার কান্না এক মুহুর্তেও জন্যও থামেনি আনছারের মায়ের। ঘুমের ঘোরে চিৎকার করে ওঠেন আনছারের নাম ধরে। তিনি বলেন, ‘আর কত অপেক্ষা ! মন তো মানছে না।’ এখনো তিনি অপেক্ষা করে আছেন হয়তো তার ছেলে আনসার ফিরে আসবে। আবারো মা বলে ডাকবে।
নুরজাহান বলেন, ‘আনসার হারিয়ে যাওয়ার পর থেকে তার চিসিৎসা বন্ধ হয়ে গেছে।’ ওষুধ কেনার টাকা নেই। প্রতি সপ্তাহে তার ডাক্তার দেখানোর কথা। তা এখন বন্ধ। টাকা নেই, কী দিয়ে ডাক্তার দেখাবেন। এক দিকে সন্তানের শোক অন্য দিকে ওষুধ-পথ্যের অভাবে তিনি এখন শয্যাশায়ী। এমনকি গত এক বছর অনেক কষ্ঠ করে সংসার চালাতে হচ্ছে তাকে।
আনসারের স্ত্রী মুক্তা বলেন, স্বামী এখন নিখোঁজ, তার অনেক স্বপ্ন ছিল আমাদের এক মাত্র চাঁদনি কে নিয়ে। সেই সন্তান এখন না খেয়ে থাকছে। ভেবে পাচ্ছেন না এ সন্তানকে তিনি এখন কী করে বাঁচাবেন।
আনসার আলীর পরিবারের দাবি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাই আনছার আলীকে অপহরণ করেছে। ইলিয়াস আলীকে অপহরণ করতে গিয়েই আনসার আলীকে অপহরণ করা হতে পারে বলে তাদের ধারণা।