মৌলভীবাজারে গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের ৪২ কোটি টাকার প্রকল্প ঝুলে আছে ৫ বছর ধরে

জালাল আহমদ : মৌলভীবাজারে গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের বাস্তবায়নাধীন ৪২ কোটি টাকার প্রকল্প ঝুলে আছে ৫ বছর ধরে। নতুন করে আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় বাড়িয়েছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্র্রণালয়। গুরুতর অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। নালিশ গেছে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে। টেন্ডার আহ্বান থেকে শুরু করে প্রকল্পের নানা কাজে দুর্নীতির তথ্য-উপাত্ত দিয়ে লিখিত অভিযোগ করা হয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)। প্রকল্পের অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে ভুক্তভোগীদের সঙ্গে স্থানীয় সংসদ সদস্যও সোচ্চার রয়েছেন। প্রতিকার চেয়ে তিন দফা ডিও লেটারও দিয়েছেন। কিন্তু কোন উদ্যোগই কাজে আসছে না। উপরন্তু অভিযোগ দাখিলের পর দুর্নীতির মাত্রা আরও বেড়েছে !
বিভিন্ন দপ্তরে স্থানীয়দের দাখিল করা অভিযোগ এবং সংসদ সদস্যের ডিও লেটার পর্যালোচনায় দেখা যায়, মৌলভীবাজার জেলা সদরের স্বল্প আয়ের লোকদের জন্য জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের বাস্তবায়নাধীন সাইট অ্যান্ড সার্ভিসেস আবাসিক প্লট উন্নয়ন প্রকল্পে দীর্ঘদিন ধরে অনিয়ম-দুর্নীতি চলছে। সম্প্রতি এই প্রকল্পের বৈদ্যুতিক কাজের টেন্ডার প্রক্রিয়ায় গুরুতর অনিয়ম ধরা পড়ে।
অভিযোগ রয়েছে, গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের সাবেক চেয়ারম্যানের পছন্দের ঠিকাদারদের কাজ পাইয়ে দিতে এ অনিয়মের আশ্রয় নেয়া হয়েছিল। টেন্ডার প্রক্রিয়ায় পেশাদার ঠিকাদারদের অংশগ্রহণ থেকেই কেবল বঞ্চিত করা হয়নি। তাদের পেছনে সন্ত্রাসী লেলিয়ে দিয়ে ভয়ভীতি দেখানো হয়েছে। স্থানীয়ভাবে বিষয়টি নিয়ে চাপে পড়ে সংসদ সদস্য সৈয়দ মহসিন আলী বিগত বছরের ২০ নভেম্বর গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রীর দ্বারস্থ হন। তিনি ডিও লেটার দিয়ে পুরো বিষয়টি তার নজরে আনেন। প্রতিমন্ত্রী আবদুল মান্নান খানকে লেখা ওই ডিও লেটারে সংসদ সদস্য টেন্ডার প্রক্রিয়াকে সম্পূর্ণ সাজানো এবং আঁতাতের মাধ্যমে সরকারের ব্যাপক আর্থিক ক্ষতি করা হয়েছে বলে উল্লেখ করেন। তিনি পুনরায় টেন্ডার আহ্বান এবং প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সর্বোচ্চ মান বজায় রেখে প্রকল্পটি দ্রুত সমপাদনের জন্য তার প্রয়োজনীয় নির্দেশনা চান।
সংসদ সদস্য তার ডিও লেটারে আরও উল্লেখ করেন, পছন্দের ঠিকাদারদের কাজ দিতে গোপনে টেন্ডার প্রক্রিয়া সমপন্ন করা হয়। ৪২ কোটি টাকা মূল্যের ওই কাজের সূচনা থেকে অদ্যাবধি কোন পর্যায়েই নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা করা হয়নি। পিপিআর ২০০৮-এর বিধি লঙ্ঘন করে টেন্ডার প্রক্রিয়া সমপন্ন করা হয়েছে। মৌলভীবাজার জেলায় প্রকল্প হলেও নির্বাহী প্রকৌশলী সিলেটের দপ্তরে কোন সিডিউল পাঠানো হয়নি বলে স্থানীয় কোন ঠিকাদারই তাতে অংশ নিতে পারেননি। যেখানে সিডিউল বিক্রি করা হয়েছে তার আশপাশে সন্ত্রাসীরা সার্বক্ষণিক পাহারা দিয়ে পেশাদার ঠিকাদারদের সিডিউল কিনতে বাধা দিয়েছে। তিনি সুনির্দিষ্টভাবে অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়গুলো তুলে ধরে জানান, ঠিকাদাররা তাৎক্ষণিকভাবে অভিযোগ করে কোন প্রতিকার পাননি। প্রকল্পের পিপিতে সাবস্টেশন স্থাপনের কথা থাকলেও সেখানে ট্রান্সফরমার বসানো হচ্ছে। গত ১৫ নভেম্বর টেন্ডার অনিয়মের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ এবং পেশাদার ঠিকাদারের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে পুনরায় তা আহ্বানে গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের সাবেক চেয়ারম্যান বরাবর প্রথম ডিও লেটার দিয়েছিলেন। স্থানীয় সংসদ সদস্য সর্বশেষ গত ১৮ ডিসেম্বর গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সমপর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ফজলে করিম চৌধুরী বরাবর ডিও লেটার দেন। সেখানেও তিনি ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ এবং স্থানীয়ভাবে জবাবদিহির মধ্যে পড়ার বিষয়টি উল্লেখ করে অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধে সভাপতির হস্তড়্গেপ কামনা করেন।
এদিকে পুলিশের সাবেক সহকারী মহাপরিদর্শক মৌলভীবাজারের বাসিন্দা সৈয়দ বজলুল করিম, সাবেক অতিরিক্ত সচিব ও ঢাকাস্থ মৌলভীবাজার জেলা সমিতির সভাপতি এএস আবদুল কাদির মাহমুদসহ মৌলভীবাজার জেলার নাগরিকদের পক্ষ থেকে ওই প্রকল্পের অনিয়ম-দুর্নীতির আদ্যোপান্ত তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বরাবর একটি আবেদন করা হয়েছে। সেখানে স্থানীয় জনসাধারণের প্রত্যাশা ও জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের সাবেক চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের উদাসীনতা, অবহেলা এবং অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়টি বিবেচনায় নেয়ার অনুরোধ জানানো হয়। স্থানীয় সংসদ সদস্যসহ জেলাবাসীর দুর্নীতিবিরোধী অবস্থানকে প্রধানমন্ত্রী মূল্যায়ন করবেন আশা করে বিশিষ্টজনরা গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের ওই প্রকল্পের দ্রুততর করার আবেদন জানান।
প্রধানমন্ত্রীকে লেখা পৃথক আবেদনে রাজধানীর মোহাম্মদপুর তাজমহল রোডের বাসিন্দা আবদুল মান্নান, জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান জিএম জয়নাল আবেদীন ভুইয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অপকর্মের নানা অভিযোগ করেন। অভিযোগকারী দীর্ঘ আবেদনে সাবেক চেয়ারম্যানের দপ্তরকে ঘিরে থাকা সিন্ডিকেট ভাঙা এবং তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা প্রত্যাশা করেন। অভিযোগকারী পৃথক এক আবেদনে বিষয়টি দুর্নীতি দমন কমিশন চেয়ারম্যানের নজরে আনেন বলেও জানা গেছে।
এছাড়াও সিলেট বিভাগের জাতীয় গৃহায়ণ প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলীর অদক্ষতার অভিযোগ রয়েছে। তিনি এই বিভাগে সাবেক উপ-সহকারী প্রকৌশলী, উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তার দায়িত্বে ছিলেন এবং বিএনপি নেতা ইলিয়াছ আলীর সহচর ছিলেন। পরে তিনি তৎকালীন চেয়ারম্যানকে মোটা অংকের উৎকোচ দিয়ে নির্বাহী প্রকৌশলীর দায়িত্ব নিয়ে বহাল তবিয়তে রয়েছেন। বিভিন্ন অভিযোগের কারণে নির্বাহী প্রকৌশলী সামছুল আলমকে সম্প্রতি শোকজ করেন কর্তৃপক্ষ।
এই সব বিষয়ে খোঁজ নিতে সম্প্রতি সকালে জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের নতুন চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ খন্দকার প্রকট রোদ্রের মধ্যে নিজ হাতে ছাতা নিয়ে প্রকল্পটি পরিদর্শন করেন। তখন সাংবাদিকদের প্রশ্নে তিনি জানান, আগামী ডিসেম্বর মাসের মধ্যে কর্তৃপক্ষ প্লট সবাইকে বুঝিয়ে দিবেন। কাজের সময় এতো দীর্ঘ কেন এমন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, আমি নতুন যোগদান করেছি। যে সময় চলে গেছে তা নিয়ে কথা বলে তো লাভ হবে না। এখন অব্যশই ডিসেম্বরের মধ্যে সব শেষ করতে হবে। দুর্নীতির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এসবের প্রমাণ পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। কিন্তু সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, এখনো মাটির কাজ চলছে। দরপত্রে বালি দিয়ে ভরাট করার কথা থাকলেও তা কাঁদামাটি দিয়ে ভরাট করা হচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলাবাসীর অনেকেই মনে করেন, এতো বড় একটি প্রকল্পে স্বচ্ছতা না থাকলে ভবন তৈরি করার পর সাভারের মতো ঘটনা ঘটতে পারে। কারণ এটা পুরোটাই একটি হাওর এলাকার মধ্যে পড়েছে।