কামারুজ্জামানের ফাঁসির আদেশ

ডেস্ক রিপোর্ট : মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামানকে ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়েছে। বিচারে বদিউজ্জামানকে অপহরণের পর হত্যা সংক্রান্ত ১ নম্বর অভিযোগ, আবদুল হান্নানকে প্রায় নগ্ন করে চাবুক মারা সংক্রান্ত ২ নম্বর অভিযোগ, সোহাগপুরে গণহত্যা সংক্রান্ত ৩ নম্বর অভিযোগ, গোলাম মোস্তফাকে হত্যা সংক্রান্ত ৪ নম্বর অভিযোগ এবং ময়মনসিংহের গোলাপজান রোডের টেপা মিয়া ও তার বড় ছেলে জহুরুল ইসলাম দারাকে ধরে জেলা পরিষদের ডাকবাংলোয় আল-বদর ক্যাম্পে নিয়ে সেখানে ৬ জনকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করার ৭ নম্বর অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে।
বাকী দুটি অর্থাৎ ৫ ও ৬ নম্বর অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। (কামরারুজ্জামানের বিরুদ্ধে ৭টি অভিযোগই রিপোর্টের নিচে সারিবদ্ধভাবে দেয়া আছে)।
বৃহস্পতিবার দুপুরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন ৩ সদস্যের ট্রাইব্যুনাল এ আদেশ দেন।
রায়ের আগে বেলা ১১টা ১০ মিনিটে জামায়াত নেতা কামারুজ্জামানকে ট্রাইব্যুনালের এজলাসে আনা হয়।
বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে এ মামলার রায়ের সংক্ষিপ্তসার পড়ে শোনান বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও মো. শাহিনুর ইসলাম।
এরপর ট্রাইব্যুনালের প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান জনাকীর্ণ আদালতে রায়ের চূড়ান্ত অংশ পড়ে শোনান।
ট্রাইব্যুনাল-২ এর বিচারপতিরা তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার রায়ের ২১৫ পৃষ্ঠার মধ্যে ৬৫৮টি প্যারা পড়ে শোনান।
এ সময় ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপুসহ অন্যান্য প্রসিকিউটররা।
অপরদিকে আসামিপক্ষের কয়েকজন জুনিয়র আইনজীবী এবং অভিযুক্ত কামারুজ্জামানের আত্মীয়-স্বজনরা উপস্থিত ছিলেন।
এর আগে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে জামায়াত নেতা মোহাম্মদ কামারুজ্জামানকে প্রিজনভ্যানে করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আনা হয়।
বুধবার সন্ধ্যায় তাকে কাশিমপুর কারাগার থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে আসা হয়।
এদিকে তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় রায় ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে ট্রাইব্যুনাল এলাকায় নেয়া হয় কড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থা।
গত ১৬ এপ্রিল এ মামলার কার্যক্রম শেষে মামলাটির রায় যে কোনো দিন দেয়া হবে মর্মে অপেক্ষমান রেখে দেন ট্রাইব্যুনাল।
কামারুজ্জামানের পক্ষে সাফাই সাক্ষী হিসেবে গত ৬ থেকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত মোট ৫ জন সাফাই সাক্ষী তাদের সাক্ষ্য প্রদান করেন। সাক্ষীরা হলেন- মোঃ আরশেদ আলী, আশকর আলী, কামারুজ্জামানের বড় ছেলে হাসান ইকবাল, বড় ভাই কফিল উদ্দিন এবং আব্দুর রহিম নামে এক ব্যক্তি।
২০১২ সালের ১৫ জুলাই থেকে চলতি বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে (রাষ্ট্রপক্ষে) তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) আব্দুর রাজ্জাক খানসহ রাষ্ট্রপক্ষের মোট ১৮ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দেন।
সাক্ষীরা হলেন- আনন্দমোহন কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি হামিদুল হক, শেরপুরের মনোয়ার হোসেন খান মোহন, জহুরুল হক মুন্সী, ফকির আব্দুল মান্নান, মোশাররফ হোসেন তালুকদার, ডা. মোঃ হাসানুজ্জামান, লিয়াকত আলী, জিয়াউল ইসলাম, অ্যাডভোকেট আবুল কাশেম, জালাল উদ্দিন, শেরপুর জেলার ‘বিধবাপল্ল্লী’ নামে খ্যাত সোহাগপুর গ্রামের তিন নারী সাক্ষী (ক্যামেরা ট্রায়াল), মুজিবুর রহমান খান পান্নু এবং দবির হোসেন ভূঁইয়া। আর জব্দ তালিকার প্রথম সাক্ষী হলেন বাংলা একাডেমীর সহকারী গ্রন্থাগারিক এজাব উদ্দিন মিয়া ও মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরের তথ্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা আমেনা খাতুন।
গত বছরের ৪ জুন কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। জামায়াতের এই নেতার বিরুদ্ধে ৭টি অভিযোগ আনা হয়। অভিযোগগুলো হলো-
(১) একাত্তরের ২৯ জুন সকালে কামারুজ্জামানের নেতৃত্বে আল-বদররা শেরপুরের ঝিনাইগাতী থানার রামনগর গ্রামের আহম্মেদ মেম্বারের বাড়ি থেকে বদিউজ্জামানকে অপহরণ করে নির্যাতন করে পরদিন হত্যা করা হয়।
(২) কামারুজ্জামান ও তার সহযোগীরা শেরপুর কলেজের অধ্যক্ষ সৈয়দ আবদুল হান্নানকে প্রায় নগ্ন করে শহরের রাস্তায় হাঁটাতে হাঁটাতে চাবুক পেটা করা।
(৩) একাত্তরের ২৫ জুলাই আল-বদর ও রাজাকাররা পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ে শেরপুরের সোহাগপুর গ্রামে নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালায় এবং নারীদের ধর্ষণ করে।
(৪) একাত্তরের ২৩ আগস্ট কামারুজ্জামানের নির্দেশে আল-বদর সদস্যরা গোলাম মোস্তফাকে ধরে সুরেন্দ্র মোহন সাহার বাড়িতে স্থাপিত আল-বদর ক্যাম্পে নিয়ে যান। সেখানে কামারুজামান ও আল-বদররা তাকে গুলি করে হত্যা করেন।
(৫) মুক্তিযুদ্ধকালে রমজান মাসের মাঝামাঝি কামারুজ্জামান ও তার সহযোগীরা শেরপুরের চকবাজার থেকে লিয়াকত আলী ও মুজিবুর রহমানকে অপহরণ করে বাঁথিয়া ভবনের রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে যান। সেখানে তাদের নির্যাতনের পর থানায় চার দিন আটকে রাখা হয়। পরে কামারুজ্জামানের নির্দেশে ওই দুজনসহ ১৩ জনকে ঝিনাইগাতীর আহম্মেদনগর সেনা ক্যাম্পে পাঠানো হয়। পরে লিয়াকত, মুজিবুরসহ ৮ জনকে উপজেলা পরিষদের কার্যালয়ের কাছে সারিতে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়।
(৬) একাত্তরের নভেম্বরে কামারুজ্জামানের নির্দেশে আল-বদর সদস্যরা টুনু ও জাহাঙ্গীরকে ময়মনসিংহের জেলা পরিষদের ডাকবাংলোতে আল-বদর ক্যাম্পে নিয়ে যান। টুনুকে সেখানে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। জাহাঙ্গীরকে পরে ছেড়ে দেয়া হয়।
(৭) মুক্তিযুদ্ধকালে ২৭ রমজান কামারুজ্জামান আল-বদর সদস্যদের নিয়ে ময়মনসিংহের গোলাপজান রোডের টেপা মিয়া ও তার বড় ছেলে জহুরুল ইসলাম দারাকে ধরে জেলা পরিষদের ডাকবাংলোয় আল-বদর ক্যাম্পে নিয়ে যান। সেখানে ৬ জনকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়।
এর আগে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতি অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ দুটি মামলার রায় দিয়েছেন। অন্যদিকে ট্রাইব্যুনাল-১ থেকে একটি মামলার রায় হয়েছে।
উল্লেখ্য, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগের মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুলাই জামায়াত নেতা মুহাম্মাদ কামারুজ্জামান হাইকোর্টে জামিন নিতে আসলে তার জামিন মঞ্জুর হওয়ার পর হাইকোর্ট এলাকা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশ তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতার করে।
কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে গত বছরের ৩১ জানুয়ারি ৮৪ পৃষ্ঠার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল-১।
এরপর ১৬ এপ্রিল চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপুর এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কামারুজ্জামানের মামলাটি ট্রাইব্যুনাল-১ থেকে ট্রাইব্যুনাল-২ এ স্থানান্তর করা হয়।
মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ কামারুজ্জামানের মামলার রায়সহ মোট ৩টি রায় ঘোষণা করা হলো।
অন্যদিকে ট্রাইব্যুনাল-১ এ শুধুমাত্র আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলার রায় ঘোষণা করা হয়