আমাদের গণতন্ত্র ও জাতীয় সংসদ
আব্দুল আহাদ : পাকিস্তান আমলে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা ছিলনা বলে পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ বর্তমান বাংলদেশের জনগণ ছিল ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত। সেই বঞ্চনা আর যাতনা থেকেই যে ক্ষোভ ও চেতনার জন্ম লাভ করেছিল তার ছিল স্বাধীকারের দাবী। একটি স্বাধীন-সার্বভৌম সমৃদ্ধ আত্মমর্যাদাশীল জাতি গঠনে মহান মুক্তিযোদ্ধ সংগঠিত হয়। মুক্তিযোদ্ধের বিজয় এদেশের মানুষকে বেঁচে থাকার নতুন স্বপ্ন দেখিয়েছিল। মানুষের আশা ছিল স্বাধীনতা অর্জন করেছি, এখন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশ নিজের অবস্থান তোলে ধরতে সক্ষম হবে। এখনও এদেশের মানুষ সেই স্বপ্ন ধারণ ও লালন করে বেঁচে আছে। নেতা-নেত্রী ও রাজনীতিবিদরা বিভিন্ন সময়ে প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে ও নিজেদের স্বার্থকে প্রধান্য দিতে এমন কিছু করেন যা জাতিকে শুধু ব্যতিত করেনা, জাতীয় স্বার্থে বড় ধরনের আঘাত করে। আমাদের জাতীয় সংসদ এদেশের মানুষের আশা-আকাংখার প্রতীক। জাতীয় সংসদ নির্বাচন এলে এদেশের মানুষ বুকভরা আশা আর সোনালী স্বপ্ন দেখে প্রতিনিধি নির্বাচিত করে। তারা মনে করে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সংসদে গিয়ে দেশ, জাতি ও নিজের এলাকার মানুষের পক্ষে কথা বলবেন। কিন্তু হতভাগা ঐসব মানুষের স্বপ্ন বাস্তবতায় পরিণত হতে অনেক অপেক্ষার প্রহর গুণতে হয়। ৯০র’ এরশাদ সরকার বিরোধী আন্দোলনে যারা রাজপথে ছিল তাদেরই একটি সংগঠন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদীদল (বিএনপি) এরশাদ পরবর্তী সময়ে সরকার গঠন করে। বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের বক্তব্য, তখন থেকেই আমাদের সংসদীয় গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু করে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ৯১সালের নির্বাচন যে গ্রহন যোগ্যতা পেয়েছিল, তৎকালীন জাতীয় সংসদ নির্বাচন তখন তা প্রমাণ করে। বিরোধীদল হিসাবে আওয়ামীলীগ সংসদে যেভাবে ভূমিকা রাখার কথা ছিল তারা তেমন ভূমিকা পালন করেনি। বার বার কারণে-অকারণে সংসদ থেকে ওয়াকাউট, এমনকি সংসদ বর্জন অনেকটা হতাশ করেছিল এদেশের মানুষকে। পরবর্তীতে অনেক আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে ৯৬সালে আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন জোট জয়লাভ করলে বিএনপিও বিরোধীদল হিসাবে যথাযথ দায়িত্ব পালন করেনি। খোড়া অজুহাতে তারা আওয়ামীলীগের মতই সংসদ বর্জন করে। রাষ্ট্র পরিচালনায় সরকার কি করছে না করছে এসব বিষয় তুলে ধরতে বিরোধীদলেরই প্রয়োজন, অথচ বিরোধীদল সংসদের বাহিরে থাকায় সরকারের কাজকর্ম নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা করার সুযোগ থেকে নিজেরাই ইচ্ছাকৃত ভাবে দূরে রয়েছে। এদেশের মানুষ বড়ই আশাবাদী, আশাার উপরই শত সমস্যা মোকাবেলা করে তারা বেঁচে আছে। যারা রাষ্ট্র পরিচালনার বাহিরে থাকে বা বিরোধীদল হিসাবে পরিচিত তারা সরকারের বিভিন্ন কাজকর্মের সমালোচনা করে জনগণের পক্ষে কথা বলার সুযোগ পায়। যা অনেকটা সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনের সুযোগ করে দেয়। মানুষ মনে করে সরকার বিরোধীরা যা বলছে তা তারা করলে এদেশের মানুষ তার অধিকার পাবে, সুখে শান্তিতে বসবাস করতে পারবে। বিরোধীদলের কথায় সহজ-সরল দেশবাসী বিশ্বাস করে পরবর্তীতে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব তাদেরই হাতে তোলে দেয়। এভাবেই বিগত ২৩বছর ধরে চলছে এদেশের ক্ষমতার পালাবদলের রাজনীতি। ২০০১সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট যে অভাবনীয় সফলতা অর্জন করে রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসেছিল, ২০০৮সালে তার চেয়ে অনেক বেশি সফলতা অর্জন করতে সক্ষম হয় আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট। এ নির্বাচনের ফলাফল আওয়ামীলীগ বিরোধীদের শুধু পরাজিত করেনি, রাজনৈতিক অঙ্গনে তাদের অস্থিত্বকে হুমকির মুখে ফেলেছিল। ২০০১সাল ও ২০০৮ সাল পরবর্তী সময়ে এদেশের মানুষ পূর্বের মত একই দৃশ্য দেখেছে। যারা জয়লাভ করতে পারেনি, তারা কারণে-অকারণে সংসদ বর্জন করে এদেশের মানুষের প্রতি অসম্মান প্রদর্শন করেছে। তারা ক্ষমতা লাভের জন্য জনগণকে যে প্রতিশ্রুতি দেয় তা যে বাস্তবায়ন করেনা তা এদেশের মানুষ বার বার দেখে আসছে। বিরোধীদলে বিগত ২৩বছর ধরে যারা ছিল তারা নিজ স্বার্থে সংসদ বর্জন করলেও সংসদ সদস্য হিসাবে সুযোগ-সুবিধা থেকে নিজেদেরকে বঞ্চিত করেনি। বেতন-ভাতা থেকে শুরু করে সব ধরণের সুযোগ-সুবিধা আদায়ে নিজেদেরকে দূরে রাখেননি। যারা জনগণের ভোট নিয়ে বিজয়ী হয়ে সংসদে না গিয়ে তার দায়িত্ব পালন করেনা, তাদের চেয়ে জাতির জন্য বড় প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারী কে হতে পারে? নির্বাচন এলে সহজ-সরল মানুষজনকে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোট নিয়ে যারা জনগণের কথা ভুলে যায়, তাদের দ্বারা যে এদেশের মানুষের কল্যাণ হবে না, একথা বুঝতে হবে ভোটারদের। বিগত ৪টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২টি দলই ক্ষমতার পালাবদলে ছিল। তারা নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে মানুষজনকে যে ওয়াদা দেয় নির্বাচনের পর পরই তারা সেই ওয়াদা ভঙ্গ করতে শুরু করে। বর্তমান সরকার জনস্বার্থের সঙ্গে সম্পর্ক নেই এমন অনেক আইন তৈরি করলেও সংসদ বর্জন করা যাবে না, এমন আইন তৈরি করার কোন উদ্যোগ নিচ্ছে না, শুধু বিরোধীদলের উদ্দেশ্যে সরকার দলের লোকজন বলছেন, তারা সংসদকে অকার্যকর করতে চায়। বিরোধীদলের সংসদ বর্জন জাতির জন্য ক্ষতির কারণ হলে এ ব্যাপারে আইন করতে অসুবিধা কোথায়? এদেশের মানুষ এ বিষয়ে যতই আবেদন-নিবেদন আর দাবী করেনা কেন এ বিষয়ে বর্তমান সরকার যে আইন করবে না তার প্রমাণ তাদের অতীতের কর্মকান্ড বহন করে। কারণ তারা মনে করে অতীতে যেভাবে ক্ষমতার পালাবদল হয়েছে আগামীতে এ ধারাবহিকতা বজায় থাকলে তাদের অবস্থান হবে বিরোধীদলে। এখন সংসদ বর্জন বিষয়ে আইন করলে আগামীতে তারা কি করবে? আসলে আমাদের বর্তমান সরকারদল ও বিরোধীদল কেউই দেশ ও জাতীর কথা চিন্তা করে রাজনীতি করেনা। যারা বিরোধীদলে তাদের একমাত্র টার্গেট তারা কিভাবে ক্ষমতা লাভ করবে, আর সরকার দলের চিন্তা হচ্ছে যেভাবে হউক আমরা ক্ষমতায় থাকতে হবে। তাদের গণতন্ত্র পরিপন্থি চিন্তাধারা ও আচরণ আমাদের জাতীয় উন্নতি-অগ্রগতি ও মানুষের মৌলিক অধিকার প্রাপ্তিতে বড় ধরণের আঘাত করছে।
এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বিগত ৪বছরে জাতীয় সংসদের কর্র্ম দিবস ছিল ৩৩৭ দিন। নবম জাতীয় সংসদের এ কর্ম দিবসগুলোতে বিরোধীদল নিজেদের পদ ধরে রাখতে নামে মাত্র উপস্থিত ছিল। সরকার দলের বেশির ভাগ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও এমপিদের উপস্থিতি সন্তোষজনক ছিল না। চলতি জাতীয় সংসদের কার্য দিবসের ৩৩৭দিনের মধ্যে বিএনপি মাত্র ৫৪ দিন উপস্থিত ছিল। বিরোধীদলের অনুপস্থিতির কারণে সরকারদলের অনেক এমপি বিভিন্ন দাবী, প্রশ্ন ও আপত্তি উত্থাপন করে অনেকটা বিরোধীদলের সদস্যের ভূমিকা পালন করতে দেখা গেছে। অনুরূপ ভাবে বিগত বিএনপি জোট সরকারের আমলে অষ্টম সংসদের পুরো মেয়াদে ৩৭৩দিনের কার্য দিবসে আওয়ামীলীগের উপস্থিতি ছিল মাত্র ১৫০দিন। সচিবালয়ের হিসাব শাখার তথ্য অনুযায়ী জাতীয় সংসদের প্রতি এমপি মাসে সম্মানী পান দেড় লক্ষ টাকা। বিগত ডিসেম্বর পর্যন্ত ৪৮ মাসে বিরোধীদলের এমপিগণ ১৬ কোটি ৯৪ লাখ টাকা পেয়েছেন। বিরোধী দলীয় নেত্রী পূর্ণ মন্ত্রীর পদ মর্যাদায় অতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধাও পেয়েছেন। এক্ষেত্রে উদাহারণ সৃষ্টি করেছেন বিরোধীদলীয় সাংসদ বিজেপির আন্দালিব রহমান পার্থ। তিনি অনুপস্থিতি কোন বেতন-ভাতা গ্রহন করেননি, এমপির সুবিধা নিয়ে বিদেশ সফরেও যাননি। অনুরূপ ভাবে বিগত সময়ে আওয়ামীলীগের এমপিরা বিরোধীদলে থেকে সংসদ বর্জন করে এভাবে বেতন-ভাতাসহ সব ধরণের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছিলেন। সংসদে না গিয়ে নিজের ঘরে বসে থেকে বেতন-ভাতা নেয়া কতটুকু যৌক্তিক তা রাজনীতিবিদরা ভেবে দেখা প্রয়োজন। দাবী আদায় করতে ও কথা বলতে জনগণ প্রতিনিধি নির্বাচিত করে যথাযথ স্থানে গিয়ে কথার বলার জন্য। যারা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে এদেশের মানুষের চেয়ে নিজের দলের স্বার্থের কথা বিবেচনায় এনে সংসদ বর্জন করে তাদের দ্বারা জাতির কি উপকার হতে পারে? দেশের মানুষ চায় সরকারদল-বিরোধীদলসহ নির্বাচিত এমপিরা সংসদে গিয়ে জাতির স্বার্থে কথা বলবে। সেখান থেকে যে সিন্ধান্ত গ্রহন করা হবে তা আমাদের জাতীয় অগ্রগতিতে মাইলফলক হিসাবে কাজ করবে। এক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সরকারদল বিরোধীদলকে কথা বলার সুযোগ না দিলে তা জাতির সামনে বঞ্চিতরা তুলে ধরার যথেষ্ঠ সুযোগ রয়েছে। প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়াকে শত চেষ্ঠা করেও রাজনৈতিক দলগুলো তাদের পকেটে বন্দি করে রাখতে পারেনি। যা ঘটে তা যথা সময়েই তারা প্রকাশ করে জাতিকে অবহিত করে। তাই আমাদের গণতন্ত্রকে সু-সংহত করতে জাতীয় সংসদকেই আলোচনা-সমালোচনা ও ঐকমত্যের কেন্দ্র বিন্দুতে পরিণত করতে হবে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত বিভিন্ন জাতি, গোষ্ঠী ও ধর্মের অনুসারীদের নিয়ে টিকে আছে গণতন্ত্র ও সু-শাসনের কারণে। তাদের জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদে বিভিন্ন সময়ে আলোচনা-সমালোচনাকে কেন্দ্র করে তুমুল বাকবিতন্ডা এমনকি হাতাহাতি হলেও একেবারে কোন দল সংসদ বর্জন করেনি। যার ফলে হাজারও সমস্যা জর্জরিত ভারত গণতন্ত্রের কারণে আজ পৃথিবীর একটি উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। বিশ্ব রাজনীতিতে ভারতকে আজ উদাহারণ হিসাবে তুলে ধরা হয়ে থাকে। আমরা কেন আমাদের প্রতিবেশীদের মত গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার আলোকে অগ্রসর হতে পারিনি। এদেশের মানুষের আশা-আকাংখা অনুযায়ী নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা সংসদে গিয়ে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ঐক্যমত পোষণ করে একটি সমৃদ্ধ দেশ গড়তে দেশপ্রেমের পরিচয় দিবেন এটাই হোক আমাদের আগামী দিনের প্রত্যাশা।