প্রেক্ষিত বাংলাদেশ: রাজনীতির ভাগ্যাকাশে কালো মেঘ

তারুণ্যের কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য বলেছিলেন,
সাবাশ বাংলাদেশ !
এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়
জ্বলে-পুড়ে-মরে ছারখার
তবু মাথা নোয়াবার নয় ॥
লাল সবুজের সমারোহে আচ্ছাদিত অফুরন্ত সম্ভাবনাময় দেশটি হচ্ছে আমার প্রিয় মাতৃভূমি সোনার বাংলাদেশ। বাংলাদেশটি এমনিতেই সৃষ্টি হয়নি। রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের রয়েছে বীরত্ব গাথা গৌরবোজ্জল ইতিহাস। বিশ্বের বুকে বাংলাদেশীরা হলেন সংগ্রামের মাধ্যমে অধিকার আদায়ের মূর্ত প্রতীক। স্বাধীনতার ৪৩ বছরে আমরা অনেক ক্ষেত্রে সফলতার উজ্জ্বল স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়েছি। আর সেক্ষেত্রে আমাদের ব্যর্থতা তা হচ্ছে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী নিজেদের ক্ষমতার মসনদ টিকে রাখতেই সোনার বাংলাদেশকে নরকে পরিণত করে তুলেছে। বর্তমান সরকারের শাসনামল পর্যালোচনা করলেই এর বাস্তব নমুনা দেখা যাবে।
বর্তমান তথ্য প্রযুক্তির এই বিশ্বে একটি দেশের শাসন ব্যবস্থায় আইনের শাসন, নাগরিক অধিকার কতটুকু সুনিশ্চিত তা নির্ভর করে ওই দেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর। বাংলাদেশের শাসন ব্যবস্থা সংসদীয় গণতন্ত্র নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের কারণে এদেশের রাজনৈতিক ভাগ্যাকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা ছিল বেশী। ১৯৯১ সালে সংসদীয় গণতন্ত্রের পুনঃযাত্রার মধ্য দিয়ে এদেশের মানুষ নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল, কিন্তু না। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব বরাবরই স্বৈরতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সব আশা ও স্বপ্নকে তছনছ করেছে। বর্তমান মহাজোট সরকার জনগণের সেই নিভু নিভু আশা ও স্বপ্নে শেষ পেরেকটিও গেথে দিয়েছে। বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে গণতন্ত্র, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, জনগণের নিরাপত্তাকে ধূলায় মিশিয়ে এক অন্ধকার শাসন কায়েম করেছে।
বিশ্বব্যাপী মানবতা, স্বাধীনতা, অধিকারের এক করুণ অবস্থার মধ্য দিয়ে যখন চোখ ফিরাই স্বদেশের দিকে, তখন কুকড়ে মরা আশাটুকু নিঃশেষিত হয়ে যায়। কারণ এই দেশ আমার সেই স্বদেশ নয়। এটি যেন পৃথিবীতে জাহান্নামের এক ব্রাঞ্চ অফিস। এখানে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার অন্তঃসত্ত্বা নারীকে রিমান্ডে নেয়া হয়। এখানে রাষ্ট্রীয় মদদে সরকারী দলের সন্ত্রাসীরা বিশ্বজিতের মতো মানবাত্মাকে কুপিয়ে মারে। এখানে পুলিশের সামনে চিহ্নিত ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা ১২০ বছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী এমসি কলেজ ছাত্রাবাস আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে। এখানে মানুষের কলিজার ছবি, রক্ত পানি মিশে একাকার হয়ে যায়। এখানে শত শত মানুষ পড়ে থাকে নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারের গার্ডারের নিচে। সাভারে ধসে রানা প্লাজার ধ্বংস্তূপের নিচে বা আশুলিয়ার তাজরীন গার্মেন্টেসের আগুনের ভষ্মে। তখন ধৈর্যের বাধ ভেঙ্গে পড়ে। ৩০ লাখ শহীদের রক্তে ভেজা, অগ্রজদের ত্যাগ ও সংগ্রামের মাধ্যমে গড়ে ওঠা এ দেশই কি আমার সেই বাংলাদেশ? আমার এই জন্মভূমিকে শাসকশ্রেণী কুশাসন, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও হানাহানি করে মহাবিশ্বের এক ডাস্টবিন বানিয়ে ছেড়েছে। নিপীড়িত-নির্যাতিত-লাঞ্চিত-অপমানিত মানুষের আর্তনাদে বিলাপ শুরু করেছে দেশের আকাশ-বাতাস। জনমনে এখন কেবল আতঙ্ক আর ভীতি।
বর্তমান মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, ব্যক্তির বাক স্বাধীনতা, সভা-সমাবেশ করার স্বাধীনতা নিয়ে এক অশুভ খেলায় মত্ত হয়ে উঠে। গুম, খুন, হত্যা, রাহাজানি, সন্ত্রাস, দুর্নীতি মিলে সৃষ্টি করা হয়েছে নারকীয় অবস্থা। সরকারকে সোচ্চার হতে দেখেছি সংবাদপত্র দমনে, সাংবাদিক নিপীড়নে, প্রতিপক্ষের রাজনৈতিক নেতা কর্মীদের গুমে, দলীয় সন্ত্রাসের ত্রাস সৃষ্টিতে, দুর্নীতির মহীরুহ উৎসব পালনে। কোথায় রাখব এই অপমান। পেশাগত দায়িত্ব পালনে পুলিশ বাহিনী দিয়ে সাংবাদিকদের ওপর হামলা করা হয়েছে, সাংবাদিকদের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে, থানা ও আদালতে মানহানি ফৌজদারি মামলা দিয়ে সংবাদ মাধ্যমের টুটি চেপে ধরা হয়েছে। প্রতিপক্ষের রাজনৈতিক মিছিল-সমাবেশে নির্বিচারে গুলি করে মানুষ হত্যা করা হয়েছে। সরকারের দুর্নীতি ও অপকর্ম প্রকাশ করাই বারবার রোষানলের শিকার হতে হচ্ছে দৈনিক ‘আমার দেশ’কে। সরকারী দলনের শিকার হয়ে এরই মধ্যে চ্যানেল ওয়ান, যমুনা টিভি, দিগন্ত টিভি, ইসলামীক টিভি, দৈনিক আমার দেশ, শীর্ষ নিউজ ডটকম সহ অসংখ্য পত্রিকা-টিভি বন্ধ করা হয়েছে। গত ১২ মার্চ ২০১২ এ বিরোধী দলের সমাবেশ সমপ্রচারের সময় একুশে টিভি, বাংলা ভিশন ও আরটিভির সমপ্রচার সম্পূর্ণ অবৈধভাবে কয়েক ঘন্টার জন্য বন্ধ করে দেয়ার নজিরও বর্তমান সরকার স্থাপন করেছে। কোথায় আমার গণমাধ্যমের স্বাধীনতা? রাষ্ট্রের এই চতুর্থ স্তম্ভকে দমন করার জন্য রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করেছে বিচার বিভাগ সহ রাষ্ট্রের সব অঙ্গকে। আর লেজুড়বৃত্তির কারণে রাষ্ট্রীয় অঙ্গগুলোও পালন করছে দেবদাসের ভূমিকা। কি দুর্ভাগ্য আমরা বাংলাদেশী। তথ্য মন্ত্রী যখন জাতীয় সংসদে ঘোষণা করেন এদেশের কোনো সাংবাদিক নির্যাতনের শিকার হইনি, তখন প্রশ্ন জাগে, এ কথা কি বোধ সম্পন্ন মানুষের পক্ষে বলা সম্ভব? এই আমার অর্জন ৩০ লাখ শহীদের রক্তের স্বাধীনতা! যেখানে বিজয়ের ৪২ বছর পরও সত্য প্রকাশের দায়ে গণমাধ্যমকে দমনের জন্য ওঠেপড়ে লাগে স্বৈরসরকার। কোথায় আমার স্বাধনিতা? কোথায় আমার মানবতা? এ যেন শৃঙ্খলিত মানবাত্মার এক করুণ আর্তনাদ।
(লেখক : সাংস্কৃতিক সংগঠক)