বাকশালী শাসনের দ্বারপ্রান্তে দেশ : বিধ্বস্ত গণতন্ত্র

সুলায়মান আল মাহমুদ : বাংলাদেশ পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম উদার গণতান্ত্রিক দেশ। কিছুদিন পূর্বেও বিশ্বের কাছে এই পরিচয়ে গর্ববোধ করতেন বিশ্বের দেশ-বিদেশে অবস্থানরত কোটি কোটি বাংলাদেশী কিন্তু বাঙ্গালী নয়। দুঃখজনক হলেও সত্য যে দীর্ঘ সংগ্রামের পথ পরিক্রমায় অর্জিত বাংলাদেশের প্রশংসনীয় গণতন্ত্র আজ ধ্বংসের পথে। এর একটাই কারণ বর্তমান ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর ক্ষমতায় টিকে থাকর স্বপ্ন। পৃথিবীর ইতিহাসে কোন সরকারের আমলেই সাড়ে ৪ বছরে এতো গণহত্যার ঘটনা ঘটেনি। আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসার পর পরই পিলখানা ট্রাজেডী বা বিডিআর বিদ্রোহী ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ৬৮ জন চৌকষ সেনা কর্মকর্তা হত্যার মাধ্যমে গণহত্যার পরিক্ষামূলক পদ্ধতি প্রয়োগ শুরু করে। সময়ের ধারাবাহিকতায় জাতিকে পর্যায়ক্রমে মীরসরাইয়ের সড়ক দুর্ঘটনার নামে অর্ধশতাধিক স্কুলছাত্রের নৃশংস মৃত্যু, আশুলিয়া তাজরিন ফ্যাশনে দেড় শতাধিক নিরীহ শ্রমিক হত্যা, আল্লামা সাঈদীর রায় পরবর্তী আন্দোলনে দেশব্যাপী দেড় শতাধিক মুসল্লীকে হত্যা, সাভারে রানা প্লাজা ট্রাজেডিতে ১২ শতাধিক নিরীহ শ্রমিক এবং সর্বশেষ ৫ ও ৬ মের শাপলা চত্বরে গভীর রাতে ঘুমন্ত নিরীহ হেফাজতে ইসলমের উপর গণহত্যার নৃশংসতা বিশ্বের বুকে আমাদের মাথা নিচু করে দিয়েছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চ্যানেলগুলোতে প্রধানমন্ত্রীকে মিথ্যাবাদী বলার দৃশ্য বর্তমান সরকারের মুখোশ উন্মোচন করেছে। যখন এই লেখাটি লিখছি তখন সারাদেশে ১ মাসের জন্য সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করেছে সরকার। সুতরাং বাকশালী শাসনের দ্বারপ্রান্তে আমাদের বাংলাদেশের কষ্টার্জিত গণতন্ত্রকে বিধ্বস্থ করে ফেলছে। এ থেকে উত্তরণে দেশপ্রেমিক জনতার এগিয়ে আসা জরুরী।
ডিজিটাল দেশ উপহার দেবে, ১০ টাকায় চাল খাওয়াবে, বিনামূল্যে কৃষকদের সার দেবে, প্রতিটি পরিবারে একজনকে চাকরি দেবে, সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও যাবতীয় অনিয়মের মুলোচ্ছেদ করবে, সর্বোপরি বাংলাদেশের জনগণের বেঁচে থাকার অধিকার নিশ্চিত করবে বলে ২০০৮ সালে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে আওয়ামীলীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আরোহন করে। ক্ষমতা লাভের মুহূর্ত থেকেই তাদের অঙ্গসংগঠন ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও সেই সঙ্গে খোদ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা চাঁদাবাজি টেন্ডারবাজি, ভর্তি-বাণিজ্য, চুরি-ডাকাতি, দখল, লুন্ঠন, হত্যা, খুন, রাহাজানি ও বিভিন্ন সন্ত্রাসী তৎপরতা শুরু করে। ফলে দেশ জুড়ে সৃষ্টি হয় এক মারাত্মক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে দেশের জননিরাপত্তা ব্যবস্থা যেভাবে ভেঙ্গে পড়েছে সেটা স্বাধীনতা-পরবর্তী ’৭২-৭৪ সময়ের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ক্ষমতার দাপট, সীমাহীন লোভ, দুর্নিিত, স্বজনপ্রীতি, অঞ্চলপ্রীতি ইত্যাদি সরকারের সর্বত্র ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। পুলিশ দিয়ে ১৪৪ ধারা জারি করিয়ে শান্তি রক্ষার অজুহাতে বিরোধী দলের সাংবিধানিক গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করছে, যা তাদের পুরনো ফ্যাসিবাদী ধারারই অনুসরণ।
বাংলাদেশ এখন যেন পুলিশী রাষ্ট্র। রিমান্ডের নির্যাতন, হত্যা, গুম, মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি এখন পুলিশের নিয়মিত কাজে পরিণত হয়েছে। মানুষ সুবিচারের জন্য ছুটে যায় সর্বোচ্চ আদালতে। কিন্তু আশ্রয়টুকুও এখন আর অবশিষ্ট নেই বললেই চলে। গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি সহ জনদুর্ভোগ, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি, সংবাদপত্রের কন্ঠরোধ ও সাংবাদিক নির্যাতন, বিরোধী দলের উপর দমন-নিপীড়নেরও শিক্ষাঙ্গনগুলোতে ছাত্রলীগ নামধারী সন্ত্রাসের ফিরিস্থি অল্প কথায় শেষ করা কঠিনই বটে। ছাত্রলীগের অত্যাচারে গোটা জাতি যখন অতিষ্ঠ। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সবাই দিশেহারা। প্রধানমন্ত্রী কখনও বলেন, ছাত্রলীগকে ত্যাজ্য করে দিলাম, কখনও বলেন, ছাত্রলীগে অনুপ্রবেশকারী ঢুকেছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, ছাত্রলীগের দায়দায়িত্ব আওয়ামীলীগ নেবে না। যারা নিজেদের একটা ছাত্র সংগঠন চালাতে পারেন না, তারা দেশ চালাবে কিভাবে এই প্রশ্ন এখন সবার।
মহাজোট সরকারের সাড়ে চার বছরের শাসনে দেশ এখন বিপর্যায়ের শেষ কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছে। সুশাসন নির্বাসনে গেছে। দুর্নীতির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাৎ ও নিপীড়ন হয়ে দাড়িয়েছে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি। সরকারের এই একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যারাই বাধা হয়ে দাঁড়াবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর মনোভাব দেখানো হচ্ছে। এভাবে ন্যাক্কারজনক পন্থায় সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে দমনের চেষ্টার পাশাপাশি পেশাজীবি সংগঠনগুলোকে এখন সভা সমাবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। শিক্ষকদের বেতন ভাতা বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলনে পুলিশ লাঠিচার্জ ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করেছে। এর আগে শিক্ষকদের আন্দোলনে অসুস্থ হয়ে একজন শিক্ষক নিহত হয়েছেন। সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীল ক্ষুদ্র বামপন্থী দলগুলোর মিছিল সমাবেশে একই কায়দায় পুলিশ নির্যাতন চালাচ্ছে। ভিন্নমত বা ক্ষমতাসীন দলের বাইরে আর কোন রাজনৈতিক তৎপরতাকে বন্ধের চেষ্টা করছে সরকার।
বিরোধী রাজনৈতিক দল দমনের নামে সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ। সশস্ত্র সন্ত্রাসীদেরকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে যাচ্ছে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এই সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে অস্ত্র উচিয়ে পুলিশের সাথে বিরোধী ছাত্রসংগঠনের ওপর হামলা চালাচ্ছে। ২০১০ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারী সরকারী কলেজ ছাত্রাবাস পুলিশের সামনে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা পুড়িয়ে দিয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশের পাহাড়ায় এরা আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করেছে। ১১২ বছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী এম.সি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের ছাত্রাবাস ছাত্রলীগের চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা আগুন দিয়ে ছারখার করে দিয়েছে। গত ১৯ মে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে এম.সি কলেজে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষ গুলাগুলিতে সময় টিভির ক্যামেরা ভাংচুর করে সাংবাদিকদের লাঞ্চিত করা হয়েছে। ডিজিটাল এই সরকার ক্ষমতা গ্রহনের পর থেকেই দমন পীড়নের মাধ্যমে বিরোধী দলকে দুর্বল করে ফ্যাসিবাদী শাসনকে দীর্ঘায়িত করতে চাইছে। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনায় সীমাহীন ব্যর্থতা, দুর্নীতি, মানবাধিকার লংঘন ও রাষ্ট্রযন্ত্রকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহারের ফলে দেশের মানুষ সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। অপর দিকে সরকার সরাসরি জনগণের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে দেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে বর্তমান ক্ষমতাসীনদের পক্ষে কোনভাবেই বিজয়ী হওয়া সম্ভব হবে না। শুধু তাই নয়, সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তি থেকে স্থানীয় পর্যায়ের নেতারা যেভাবে দুর্নীতি ও অপরাধমূলক কার্যক্রমের সাথে জড়িয়ে পড়েছেন তাতে জনরোষের শিকার হতে পারেন। এ কারণে সরকার যেনতেন উপায়ে একটি নির্বাচন দিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসতে চাইছে। এর পর নিপীড়ন আরো তীব্র করে স্বৈরশাসকদের মতো যত দিন সম্ভব ক্ষমতায় থাকার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। কিন্তু ইতিহাস স্বাক্ষী সব জনমতের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া স্বৈরশাসকদের শেষ পরিণতি হয় চরম অবমাননাকর। আরব বিশ্বের তিন স্বৈরশাসক বেন আলী, হোসনী মোবারক আর গাদ্দাফির পরিণতি আমরা দেখেছি। বাংলাদেশেও জনমতকে উপেক্ষা করে ৭২ সালের একদলীয় শাসনের সমাপ্তি ঘটেছে দুঃখজনক রক্তাক্ত পরিণতির মধ্য দিয়ে।
মহাজোট সরকার ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিবেন এমনটা আশা করা যায় না। কোন একনায়ক ও স্বৈরশাসক ইহিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না। কিন্তু বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ধারা বজায় রাখতে হলে সরকারের একদলীয় শাসন কায়েমের যে প্রচেষ্টা চলছে তার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দলগুলোকে গণ-আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। মনে রাখতে হবে নিপীড়নমূলক শাসন যত দীর্ঘস্থায়ী হবে দেশের উন্নয়ন অগ্রগতি ও সার্বভৌমত্ব ততটাই হুমকির মুখে পড়বে। সাধারণ মানুষের জীবন যাপন দুর্বিষহ হয়ে উঠবে এবং রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের ক্ষয়ক্ষতি বাড়তে থাকবে। এসব নিপীড়নমূলক শাসন ব্যবস্থা থেকে বাংলার মানুষ মুক্তি চায়।
(লেখক : সাংস্কৃতিক সংগঠক)