প্যারিস আক্রমন ও আমাদের সহমর্মিতা

গত শুক্রবারের প্যারিস আক্রমণে নিহত ও আহতদের প্রতি প্রতিকি সহমর্মিতা জানিয়ে একদিনের জন্য ফেসবুকের প্রোফাইল পিকচারের রং পরিবর্তন করেছিলাম, পরে দেখলাম তার প্রতিবাদে ফেসবুকে রীতিমত টর্নেডো বয়ে যাচ্ছে।
আমি সচারচর কখনই এই কাজটি করিনাই… এবার করেছি। আমি যখন এটা করেছি তখন এই হামলার পিছনে কে বা কারা দায়ী এতো কিছু চিন্তা না করেই করেছি, এর কারণ দুই এক কথায় বলে বোঝানো কঠিন।
তবে যারা নানারকম তথ্য বা যুক্তি দিয়ে এর প্রতিবাদ করেছেন তাদের সাথে আমিও একমত। যদিও, কিছু আবাল খামাখা ফালাফালি করছে, যা বিরক্তিকর।
এই প্রসঙ্গে কিছু কথা না বললেই নয়। তবে তার আগে বলে নেই, জাতি – ধর্ম- বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিটি মৃত্যু, প্রতিটি খুন আমার কাছে সমান গুরুত্ব বহন করে।
১. ফ্রান্স সহ আধুনিক উন্নত বিশ্বের দেশগুলি তাদের দেশের ভিতরে কি পরিমান শান্ত, সুশৃঙ্খল পরিবেশ বজায় রাখে সেটা না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। এরা সারা বিশ্বকে অশান্ত রাখবে কিন্তু নিজের দেশে একটা আচড়ও লাগতে দেবে না।
একটা উদাহরণ দেই, সিঙ্গাপুরে সংবাদপত্রের সবচেয়ে বড় শিরোনাম হয় এরকম, ‘শহরের জনৈক বাসিন্দা, রাস্তায় অবৈধভাবে ময়লা ফেলার অপরাধে পাঁচশত ডলার জরিমানা খেয়েছেন’। যেখানে, চুরি – ডাকাতি – খুন – রাহাজানি এই সব অনেকটা অকল্পনীয় ব্যাপার, এরকম একটি শহরে হঠাৎ বোমা মেরে পাঁচজন মানুষের মৃত্যু!
যেখানে মৃত্যু হলো ডাল – ভাত, সেখানে আরও পাঁচ জনের মৃত্যু একই বার্তা বহন করে না। যদিও প্রতিটি মৃত্যুই সমান ভাবে বেদনাদায়ক।
২. কেউ কেউ যুক্তি দেখায়, ফ্রান্স সরকার এর আগে আলজেরিয়াতে এতো এতো নৃশংসতা চালিয়েছে, কাজেই তাদের প্রতি সহমর্মিতা দেখানো মানে, তাদের সেই অন্যায়কে সমর্থন করা।
একটা দেশের সরকার কি সব সময় দেশের জনগনের কথা বলে? যদি একটা দেশের সরকার অন্যায় করে, আর সেকারণে যদি কোন বিদেশী শক্তি বা কোন সন্ত্রাসী সংগঠন সেদেশে হামলা করে এক – দু’শ সাধারণ মানুষ মেরে ফেলে, তাহলে সরকার খারাপ বলে কি তারা কোন সহমর্মিতা পাবে না?
যদিও সব সরকারের অপকর্মের মাসুল সবসময় জনগণকেই দিতে হয়। তাই বলে এটা কোন ধরনের বিচার?
৩. মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস, সেটার তো কোনো শুরুও নেই, শেষও নেই। মায়ের পেটে শুয়ে শুয়ে যখন কোনো কিছু করার ছিলো না তখন মনোযোগ দিয়ে ফিলিস্তিন – ইসরাঈলের গোলাগুলির আওয়াজ শুনতাম, সেই অবধি চলছেই।
ভাই – ভাই সম্পত্তি আর ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে বিরোধ, সেখানে বাহির থেকে খুনি ভাড়া করে এনে খুনোখুনি করবে, আর দোষ হবে বাহিরের খুনিদের, সেটা কোন বিচার?
৪. যারা ইসলাম ধর্মে বিশ্বাস করেন তারা ভালো করেই জানেন মুসলমানদের জন্য এই দুনিয়ার জীবনটা একটা পরীক্ষা কেন্দ্র মাত্র।
তাদের জীবন হবে সব সময় সংকটাপন্ন। এগুলি তাদের জন্য আল্লাহ’র পরীক্ষা। আর আল্লাহ তাদেরকেই পরীক্ষা করেন যারা এর যোগ্য।
যার ঈমানের লেবেল যত উপরে, তার পরীক্ষা তত কঠিন। যার কোনো পরীক্ষা নেই, he/she is really in trouble.
আজ যে সারা বিশ্বের সব শক্তি এক হয়ে মুসলমানদের পিছে লেগেছে তার কারণ একটাই। আর তা হলো, আমরা তাদের সবার থেকে আলাদা।
তারা জানে আমাদের শক্তি। আমরা কারো দয়া বা সহমর্মিতায় চলি না, আমরা দয়া চাই একমাত্র তাঁর কাছে যিনি প্রকৃত দয়া করার মালিক।
আমরা পবিত্র কোরআনের অনুসারী, যেটা এক অনন্য কিতাব। অবতরণের পর থেকে আজ অবধি যার প্রসার বা ব্যাপ্তি বেড়েই চলেছে এবং চলবে অনন্তকাল ইনশা আল্লাহ।
৫. সব শেষে, আমরা যারা মুসলমানরা বিশ্বের বিভিন্ন খৃষ্টান বা অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের দেশে বসবাস করি, তাদেরকে অনেক ধরনের সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়ে চলতে হয়।
সবচেয়ে বড় কথা হলো, আমরা প্রতিটি মুসলমান ইসলাম ধর্মের প্রতিনিধিত্ব করি। কাজেই এই ধরনের ঘৃন্য ঘটনাগুলিতে যেখানে আমাদের কে ভুল ভাবে উপস্থাপন করার জন্য সর্ব শক্তি এবং অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে সেখানে আমাদেরকেই সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে।
সবাইকে দেখানো উচিৎ, আমরা আসলেই কেমন। যে যে ভাবেই উপস্থাপন করার চেষ্টা করুক না কেনো, আমাদের স্বকীয়তা তারা কোন দিনই নষ্ট করতে পারবে না। এটাই আমাদের অনন্য বিশেষত্ব।
লেখকঃ মাহমুদুল খান আপেল (মিশিগান থেকে)