সাহসী কন্যা শতাব্দী জানালো তার স্বপ্নের কথা
নিউজ ডেস্ক :: শতাব্দী শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট স্কুলের দশম শ্রেণিতে আর তার ছোট বোন সপ্তর্ষী একটি কিন্ডার গার্টেনে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ছে। মা শিক্ষক বাবা শফিকুজ্জামান ঠিকাদার।
শতাব্দী এখন সারা দেশে আলোচিত। আর তার অধিকার আদায়ের সাহস প্রেরনা যোগাচ্ছে অনেককেই।
যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে সাহস করে রাজপথে বলেছে, ‘হ্যালো মিনিস্টার, আই হ্যাভ এ কোয়েশ্চেন।’ মন্ত্রী জানতে চাইলেন, কী বলবে তুমি? ঘটনাটি গত শনিবারে ঘটে।
প্রতিদিন শতাব্দীকে স্কুলে হেঁটে হেঁটে আসা-যাওয়া করতে হয়। একইভাবে আসা-যাওয়া করতে হয় অন্য অনেক নারীকেও। বাস তাদেরকে নেয় না। মন্ত্রী তার প্রশ্ন শুনে বসে থাকেননি। পরদিন সকাল ৬টা থেকে বিআরটিসি বাস চালু করে দেন। শতাব্দীর সঙ্গে অনেক নাগরিকের মুখে হাসি ফোটে। একইসঙ্গে ঢাকা ও চট্টগ্রাম নগরীতেও মহিলাদের জন্য পৃথক মহিলা বাস সার্ভিস চালু করেন।
শতাব্দী একজন সাধারণ যাত্রীর মতোই বাসে চড়ে স্কুলে যেতে চাইত। কিন্তু বাস না পেয়ে বন্ধুদের সঙ্গে পায়ে হেঁটেই স্কুলে আসা-যাওয়া করতে হয়েছে শতাব্দীকে। দিন দিন তার মনে একটি প্রশ্ন বড় হতে থাকে। কেন স্কুলে যেতে বাস পাবে না বা বাস তাদেরকে কেন নিতে চায় না? প্রতিদিনই ভেবেছে কাকে বলবে তাদের এই কষ্টের কথা, এর সমাধানই বা কে করবে? এসব প্রশ্নের উত্তর বার বার খুঁজে ফিরছিল সে, কিন্তু পায়নি।
প্রতিদিনের মতো স্কুল ছুটির পর রাজধানীর শহীদ রমিজুদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট স্কুলের ছাত্রী শতাব্দী বাস না পেয়ে পায়ে হেঁটেই বাসায় ফিরছিল। রেডিসন হোটেলের উল্টো দিকে কুর্মিটোলা হাসপাতালের সামনের রাস্তায় জটলা দেখে কৌতূহলী হয়ে ভিড়ের মধ্যে ঢুকে পড়ে সে। লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে মন্ত্রীকে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করছেন। ভিড় ঠেলে শতাব্দী সেখানে হাজির হয়ে ভাবছে, ‘আমি তো হেঁটে এসেছি, আমাকে তো বাসে উঠতে দেয়নি। তাছাড়া অন্যান্য নারীকেও কেউ বাসে উঠতে দেয়নি, আমাদের কি বাসে ওঠার দরকার নাই? সে সুযোগ খুঁজছে মন্ত্রীকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করার।
সেদিনের ঘটনা সম্পর্কে শতাব্দী জানায়, ‘আমি একজন সাংবাদিককে প্রশ্ন করলাম ‘আমি কি উনাকে (মন্ত্রী) প্রশ্ন করতে পারব? উনি (সাংবাদিক) আমাকে বললেন, পারবে, তুমি একটু সামনে দাঁড়িয়ে হাত উঠিয়ে প্রশ্ন করতে পারবে। উনি (সাংবাদিক) আমাকে প্রশ্ন করলেন, কী প্রশ্ন করবে? আমি যাতায়াতের বিষয়টা বললাম। তখন উনি বলেন, কর..। তবে উনি ভেবেছিলেন, আমি প্রশ্নগুলো মন্ত্রীকে করতে পারব না।’
সাংবাদিকদের কথা বলা শেষ হলে আমি মন্ত্রীকে প্রশ্ন করার জন্য ‘হ্যালো মিনিস্টার আই হ্যাভ এ কোয়েশ্চেন’।
সেই ‘কোয়েশ্চেন’ গোটা পরিবেশটাকে স্তব্ধ করে দেয়। মন্ত্রীও হয়তো অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করেন ‘আর ইউ জারনালিস্ট’ ? শতাব্দীর ‘না’ সুচক মাথা নাড়ানো দেখে অভয় দেন মন্ত্রী কথা শুনতে চাইলে সাহস ফিরে পায় শতাব্দী। অনেকদিনের জমানো কথাগুলো নির্দ্বিধায় বলে দেয় সে।
তুলে ধরে, শুধু নারী হওয়ার কারণে তাদের যাতায়াত সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়ার কথা। ১৩-১৪ বছরের একটি কিশোরীর মনের সকল অনুভূতির সঙ্গে মিলে যায় মন্ত্রীর অনুভূতি। সঙ্গে সঙ্গে একটি বাসের ব্যবস্থা করে দিলেন শতাব্দীদের জন্য। প্রচার হয়ে গেল দুর্দান্ত এক সাহসী মেয়ের গল্প। রাতারাতি শতাব্দীকে চিনে নিল দেশ-বিদেশের কোটি কোটি মানুষ। পরের দিন থেকে শুরু হয়ে গেল শতাব্দীর সাক্ষাৎকার।
শতাব্দী জানায়, বাঙালি নারীরা সাধারণত জন্মের পর থেকে বিয়ের আগ পর্যন্ত বাবা-মা, বিয়ের পর স্বামী এবং তারপর সন্তানের ওপর নির্ভরশীল হয়ে জীবন শেষ করেন। এই প্রথাকে ভাঙতে চেয়ে যোগাযোগমন্ত্রীকে প্রশ্ন করে তাক লাগানো দশম শ্রেণির ছাত্রীর নাম শামসুন নাহার শতাব্দী।
শতাব্দীর মতে, একজন নারী বাবা-মা, স্বামী বা সন্তান কারও ওপর ভরসা করে নয়, নিজের কর্ম দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়ে সংসারে সমৃদ্ধি আনতে সমানভাবে অংশ নেবে।
শতাব্দী বলে, ‘অনেক সময় স্যার ম্যাডামদেরকেও শেয়ার করতাম যাতায়াতের বিষয়টা নিয়ে। তাদেরকেও বলতাম যদি কখনো কাউকে পাই তবে অবশ্যই বলবো। তবে মন্ত্রীকে কাছে পেয়ে এভাবে যে বলতে পারবো এ কথা কখনো ভাবতে পারিনি।
মন্ত্রীকে বলার পরে আমার মধ্যে কোনো ‘রিঅ্যাকশন’ ছিল না। অন্যদিনের মতোই মনে হচ্ছিল। বাসায় ফিরে এসে দেখি আম্মু বাসায় নেই। খালামনিকে বল্লে বিশ্বাস করেনি, ভেবেছে দুষ্টুমি করছি। প্রথমে আমার খালাতো ভাই আমাকে ফোন দিয়ে বলে আমাকে নেটে দেখাচ্ছে। যখন টিভিতে অনলাইনে দেখতে পেলাম তখন মনে হলো কিছু একটা হয়েছে। বন্ধুরা আমাকে ফোন দিয়ে বলছে তোকে অনলাইন, টিভিতে দেখাচ্ছে। আমি তো অবাক। আমি ভাবতেও পারিনি এমন হবে
ছোট থেকেই শতাব্দীর স্বপ্ন চিকিৎসক হবে। মা আকলিমা তরফদার শামসুন নাহারও স্বপ্ন দেখেন একই। আর ছোট মেয়ে সর্প্তষী হবে সাংবাদিক। মায়ের স্বপ্নকে লালন করছে দুই বোন মিলে।
শতাব্দী বলে, ‘আমার আর মায়ের ইচ্ছে আমি হবো ডাক্তার আর আমার ছোটবোন হবে সাংবাদিক। সপ্তর্ষী সাংবাদিক হয়ে কোথায় গরীব দুস্থ মানুষ অসুস্থ হয়ে আছে খুঁজে বের করে তাদের দুর্দশার কথা তুলে ধরবে। আমি সেই সব মানুষকে সেবা করবো। সে আরও বলে, ‘আমি আর আমার বোন মায়ের স্বপ্ন পূরণে প্রস্তুতি নিচ্ছি। সবাই দোয়া করবেন।’