সুনামগঞ্জে তাপসের বাবা মার চোখের জল আজও থামেনি…
সুনামগঞ্জ সংবাদদাতা : ২০১৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর প্রতিপক্ষের গুলিতে ওপারে চলে গিয়েছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের ছাত্র তাপস সরকার। এরপর কেটে গেছে ১৬ মাস।
তার রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে ছাত্রলীগের কোনো পক্ষ ক্যাম্পাস রাজনীতিতে হয়েছে প্রতিষ্ঠিত। আবার কেউ বা হয়েছে ক্ষতিগ্রস্থ। সেসব পুরোনো কথা। যে ক্যাম্পাস তাপস হত্যার প্রতিবাদে উত্তাল হয়েছিল সেই ক্যাম্পাসে তাপসের জন্য একটা শব্দও খরচ হয় না এখন।
তবে দুজনের মনে এখনও ‘বর্তমান’ তাপস। হয়তো এমনিভাবে থাকবে সারাজীবন। বলছিলাম তাপসের হতভাগ্য বাবা-মা বাবুল সরকার ও অঞ্জলী রায় সরকারের কথা।
এখনও ছেলে হারানোর হাহাকার নিয়ে বিছানায় যান বাবা বাবুল সরকার। এখনও ঘুমের ঘোরে ছোট ছেলের চুলে বিলি কাটেন মা। এখনও মধ্যরাত হলেই শোকাস্তব্ধ বাবা মায়ের গলায় লেগে থাকা আত্মচিৎকারের কান্না মাটির দেওয়াল ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে পাড়ায়। হারিয়ে যাওয়া সন্তান এখনও নির্বিঘ্নভাবে ঘুমাতে দেয় না বাবা-মাকে। সুনামগঞ্জ জেলার জামালগঞ্জ থানার নিধিপুর গ্রামে তাপসের সেই মাটির ঘরে চলছে এখনো মৃত্যুকে ভোলানোর নিরন্তর সংগ্রাম।
ছেলে হারানোর পর অসুস্থ্য থেকে আরও অসুস্থ্য হয়েছেন এই দুইটা মানুষ। দারিদ্রতার মধ্যে কোনোরকম খেয়ে না খেয়ে শরীরটাকে টেনে নিয়ে চলেছেন দুজন।
বুধবার (৪ মে) সকালে মুঠোফোনে কথা হয় তাপস সরকারের বড় ভাই আশিস সরকারের সঙ্গে। তিনিই জানালেন বাবা-মায়ের সারাক্ষণ তাপস স্মৃতি হাতড়ে বেড়ানো শোকের কথাগুলো।
সোমবার (২ মে) চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকাণ্ডের অভিযোগপত্র জমা দেওয়ার পর সেই শোকটা যেনো আবারও নতুন করে ধরা দিয়েছে তাদের মনে।
ছেলে হত্যার দীর্ঘদিনেও হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ না দেখে বিচারের আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন। এখন আবারও মনে আশার বীজ সঞ্চার হয়েছে তাদের। এখন আশা ছেলে হত্যার বিচার পাবেন তারা।
আশিস সরকার বলেন, ‘আমার ভাই হত্যার ঘটনায় আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেওয়ার বিষয়ে আমাদের কেউ জানায়নি। আমি ফেসবুকে দেখেছি বিষয়টি। পরে যোগাযোগ করে নিশ্চিত হলাম ২৯ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। এরপর আমার অসুস্থ্য মা-বাবাকে জানালাম। তারা ছেলের জন্য অনেকক্ষণ কাঁদলেন। তারা কিছু চায় না, চায় শুধু যারা তাদের ছেলেকে হত্যা করেছে তাদের বিচার যেনো হয়। দ্রুত যেনো মূল খুনিকে গ্রেফতার করা হয়।’
চোখ বুজে ওঠা কান্নায় আশিস সরকার বলতে থাকেন, ‘আমার ভাই হারানোর ১৬ মাস হয়ে গেল। ও চলে যাওয়ার পর থেকে কান্নাই আমাদের চোখের প্রতিশব্দ হয়ে গেছে। ভাইটা এভাবে চলে গেল-কেউ আমাদের খোঁজ রাখেনি। কতজন কত আশা দিয়েছিল। আমাদের দিয়ে কত ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা হলো। কত দৌঁড়ঝাপ করানো হলো। কিছুই হলো না। ১০টার মধ্যে ১টা আশাও যদি পূরণ করতো।’
বাবুল সরকারের পাঁচ সন্তানের একজন দিনমজুর, আরেক ছেলে দোকানে কাজ করে। দুজন পড়ছে বিদ্যালয়ে। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায় পা রাখা তৃতীয় সন্তান তাপস সরকারই ছিলেন পরিবারের আশা-ভরসা। সেই ছেলেটিই এভাবে চলে গেল, এখনও তা মানতে পারছে না পরিবারের কেউই।
তাই বড় ভাই আসিশ সরকার বলেন, ‘বাবা বর্গাচাষী, আমি সামান্য বিক্রয়কর্মী, বসতভিটাও দেনায় কেনা। টেনেটুনে চলে আমাদের সংসার। বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙ্গিনায় পা রাখা তাপসকে ঘিরেই দানা বেধেছিল আমাদের ভবিষ্যতের স্বপ্ন। সেই সাধারণ থেকে অসাধারণ করে তুলবে আমাদের। আরও কত স্বপ্ন। সেই ভাইটাই নাই হয়ে গেল অকালে। যার ভাই হারিয়েছে সেই বুঝে কষ্টটা কী রকম। অন্যরা তা বুঝবে না। এখন বিচার হলে আমরা কিছুটা হলেও সেই শোক কাটিয়ে উঠতে পারতাম।’ বলতে বলতে ফের কথা ডুবে যায় কান্নায়।