কী ঘটছে সৌদি আরবে?

৩১ বছর বয়সী মোহাম্মদ বিন সালমান হলেন সৌদি আরবের যুবরাজ এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী। ফরাসি দার্শনিক কবি লেভির পদাঙ্ক অনুসরণ করে এই উদ্যমী এবং সংস্কারমুক্ত যুবরাজ নিজেকে এমবিএস বলে পরিচয় দিতে ভালোবাসেন। ফরাসি ওই দার্শনিকের পুরো নাম বার্নার্ড হেনরি লেভি হলেও নিজেকে তিনি বিএইচএল বলে পরিচয় দিতেন। যুবরাজ যে খেতাব পেয়েছেন, তা অন্য যুবরাজরাও বংশপরম্পরায় পেয়ে থাকেন। এই সিংহাসনের দ্বিতীয় হকদার হিসেবে তার পেছনেই রয়েছে তার চাচাতো ভাই যুবরাজ মোহাম্মদ বিন ইউসুফ। ইতোমধ্যেই উপসাগরীয় অঞ্চলের বেশিরভাগ রাষ্ট্রে কুটনৈতিক দায়িত্ব তার উপর ন্যস্ত হয়েছে এবং তিনি জর্দানে নতুন সহযোগিতা পরিষদের দায়িত্বে আছেন।
‘সৌদি ভিশন ২০৩০’ এর প্রবক্তা হলেন এমবিএস নিজে। সৌদি আরবের ইতিহাসে এই ভিশনকে বলা হচ্ছে অনেক উচ্চাকাঙ্ক্ষী পরিকল্পনা। কারণ খনিজ তেলের উপর থেকে নির্ভরতা কমিয়ে স্থানীয় অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার কোনো পরিকল্পনা এর আগে নেয়া হয়নি। গত সপ্তাহেই এই যুবরাজ খুব শান্তভাবে সৌদি আরবের তেলমন্ত্রী আলী আল নায়িমিকে পদচ্যুত করলেন। অথচ নায়িমি গত বিশ বছর ধরে সৌদি আরবের তেলমন্ত্রীর পদে নিয়োজিত ছিলেন। তাকে পদচ্যুত করার পর তার স্থানে স্থলাভিষিক্ত করা হয় খালিদ আল ফালিহকে, যিনি তেল বাণিজ্যে বিশিষ্ট টেকনোক্রেট হিসেবে পরিচিত।
পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোর প্রতিনিধিদের রিপোর্ট মারফত আমরা জানতে পারছি যে সৌদি আরবে এই তরুণ যুবরাজকে ‘মি. এভরিথিং’ নামে ডাকা হচ্ছে। গত মাসে ব্লুমবার্গ ম্যাগাজিনকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে মোহাম্মদ বিন সালমান নিজেকে চিহ্নিত বা অঙ্কিত করার ক্ষেত্রে দুটি লাইন ব্যবহার করেছিলেন। সেখানে তিনি নিজেকে, ‘সেই ব্যক্তি যিনি নিজের ভিশনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন এবং যিনি সাবেকদের পরিবর্তে অভিযোজিত হয়েছেন।’ ‘এখানে একটা বড় পার্থক্য রয়েছে’ বলে তিনি আরও জানান, ‘প্রথমত, সে(স্টিভ জবস) অ্যাপল তৈরি করতে পারে। দ্বিতীয়ত তিনি একজন সফল চাকুরিজীবি। স্টিভ জবস অথবা মার্ক জুকারবার্গের কাছে যা উপাদান ছিল আমার কাছে তার চেয়েও বেশি উপাদান রয়েছে। যদি আমি তাদের পন্থা অনুযায়ী নিয়মানুসারে চলি, আমি তাহলে কি তৈরি করবো? এসব কিছুই আমার মাথায় ছিল যখন আমি তরুণ ছিলাম।’
উচ্চাভিলাষী এই যুবরাজের হাত ধরেই তার নিজের দেশ এক বিরাট পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যাবে, যে দেশকে তিনি গত অর্ধ শতাব্দী ধরে দেখে আসছেন। চলতি সপ্তাহে দাদ, বাদশা সালমান বিন আবদুল আজিজ আল সাউদ এক উদ্ভট ডিক্রি জারি করেছেন। ওই ডিক্রি বলে রাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থা এবং প্রতিষ্ঠানকে তার সন্তানের পরিকল্পনামাফিক চলার নির্দেশ দিয়েছেন। ২০১৫ সাল জুরে রিয়াদের একক শাসনকাঠামো এটা পরিস্কার করেছে যে সৌদি আরবের বৈদেশিক রিজার্ভ ভাবনার চেয়েও দ্রুতগতিতে ফুরিয়ে যাচ্ছে এবং সেই সমস্যার কোনো সমাধানও করার চেষ্টা হয়নি। যা আগামী ২৪ মাস ধরে করা হবে বলে পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।
অবশ্য নতুন চিন্তার প্রয়োজনীয়তা ছিল। আল নায়িমির স্থানে আল ফালিহকে দিয়ে স্থলাভিষিক্ত করা ঘটনা শিরোনামে পরিনত হয়েছিল। যেমনটা যুবরাজ মোহাম্মদ সালমানের প্রস্তাবনার ভিত্তিতে রাষ্ট্রায়ত্ব তেল কোম্পানিটিকে বেসরকারিকরণ করে আইপিও ছাড়ার সংবাদটি শিরোনাম হয়েছিল। ধারণা করা হচ্ছে সৌদি আরমাকো যদি বিভক্ত হয় এবং শেয়ার ছাড়ায় হয় তবে শেয়ার থেকেই শুধুমাত্র দুই ট্রিলিয়ন ডলার আয় করবে দেশটি। কিন্তু এই বিশাল পরিকল্পনার মাত্র দুইটি অংশ মৌলিকভাবে পুরো রাজত্বকে পরিবর্তন করবে। সৌদি অর্থনীতিকে ঢেলে সাজানোর উদ্দেশ্য দেশটিকে তেলের উপর থেকে নির্ভরশীলতা কমাবে এবং আয়ও কমে আসবে। কিন্তু পাশাপাশি নতুন করে খোলা বেসরকারি খাত সামনের দিকে অগ্রসর হবে।
‘সৌদি ভিশন ২০৩০’ হলো রোডম্যাপ বাস্তবায়নের পদক্ষেপ মাত্র। যুবরাজের এই পরিকল্পনার ফলে উৎপাদন শিল্প প্রসার হবে। অথচ বর্তমানে এই উৎপাদন শিল্পে সৌদির অর্থনীতির একাংশ নির্ভর করে। তবে আশা করা হচ্ছে, পরিকল্পনা প্রনয়ন করলে বেসরকারি খাত থেকে ৪৫ থেকে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হবে এবং স্থানীয় চাহিদা পূরণের পাশাপাশি বেকারত্ব সমস্যা ১১ দশমিক ৬ শতাংশ থেকে কমে ৭ শতাংশে দাড়াতে পারে।
এই অনুর্বর রাজত্বের পানি খাতেও বৈপ্লবিক পরিবর্তন দরকার। সাম্প্রতিক সময়ে পরিবেশ, পানি এবং কৃষি মন্ত্রণালয় স্থাপন করা হয়েছে। আর এক্ষেত্রে বিদ্যুৎ সরবরাহের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে আল ফালিহ। কারণ সৌদি আরবে তিনি এখনও জ্বালানি সম্রাট হিসেবেই পরিচিত। অন্যদিকে গত তিন বছর ধরে সহকারীর দায়িত্ব পালন করা আহমেদ আল খুলেফিকে সৌদি আরবের কেন্দ্রিয় ব্যাংকের গর্ভনর পদে বসানো হয়েছে। সর্বশেষ রিক্রিয়েশন অ্যান্ড কালচার নামে একটি নতুন কমিশনও গঠন করা হয়েছে, যা সৌদি আরবের ইতিহাসে এই প্রথম। এই কমিশনের দায়িত্বে আছেন আহমেদ আল খাতিব নামে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী। তার সঙ্গে রাজপরিবারের রয়েছে গভীর যোগাযোগ। খাতিব দেশে নতুন পর্যটন খাত এবং বিনোদনের ব্যবস্থা করতে হিমশিম খাচ্ছেন। কিন্তু একটা কট্টরপন্থী রাজতন্ত্রে কি বিনোদনমূলক বন্দোবস্ত খুব সহজেই করা যাবে।
এমবিএস অন্তত বুঝতে পেরেছেন যে কিছু বিষয়ে স্বাধীনতা দিতে হবে। কারণ কেউই এখন রক্ষণশীল আলেমদের চাইছে না। ঐতিহ্যগতভাবেই এই আলেমরা সাউদ পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে কাজ করেন। রাজতন্ত্রের নতুন এই সদস্যটির উন্নয়ন পরিকল্পনায় এই আলেমরা যে বাধা দেয়ার চেষ্টা করবে না তা বলা যাচ্ছে না। যদিও ওই যুবরাজ দেশে লাইব্রেরি, জাদুঘরসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা নির্মানের উদ্যোগ নিয়েছেন এবং ওয়াদা করেছেন। ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের মোট বাজেটের ৬ শতাংশ সংষ্কৃতি উন্নয়নে ব্যবহার করা হবে বলেও তিনি ঘোষণা দিয়েছেন।