হাদিসের আলোকে শবে বরাতের গুরুত্ব
যেসব বরকতময় রজনীতে আল্লাহ্পাক তার বান্দাদের প্রতি রহমতের দৃষ্টি দান করে থাকেন, শবে বরাত তারই অন্যতম। তাফসীর-হাদিস ও বিজ্ঞ আলিমদের পরিভাষায় যাকে ‘লাইরাতুন নিছ্ফি মিন শাবান’ বা শাবানের মধ্য রজনী নামে অভিহিত করা হয়। যে রাতটি হল শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাত।
প্রিয় নবী (সা.), সলফে সালেহীনগণ এবং বিজ্ঞ মনীষীরা রাতটিকে অত্যন্ত গুরুত সহকারে পালন করেছেন। অনুরূপভাবে যুগে যুগে মুসলমানগণ এরই ধারাবাহিকতায় এ রাতটি পালন করে আসছেন।
পবিত্র শাবান মাস এবং এ মাসে রোজা পালনের উপর বোখারী, মুসলিম ও তিরমিযীসহ অনেক বিশুদ্ধ হাদিসগ্রন্থের বর্ণনা রয়েছে। অনুরূপভাবে এ মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাত তথা শবে বরাত সম্পর্কে ছেহাহ্ ছিত্তাহর উল্লেখযোগ্য কিতাবাদিসহ নানা নির্ভরযোগ্য গ্রন্থে প্রমাণ মেলে।
১। ছহীহ ইবনুল হিব্বান-এ হজরত মুয়ায (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘যখন শাবানের মধ্য রজনী (শবে বরাত) উপস্থিত হয় তখন এক আহ্বানকারী এ আহবান করতে থাকে, ‘‘কোনও ক্ষমা প্রার্থনাকারী আছো কি? আমি তাকে ক্ষমা করবো কোন প্রার্থী বা ফরিয়াদি আছো কি? আমি তার প্রার্থনা ও ফরিয়াদ কবুল করবো? ফলে যে যা প্রার্থনা করবে তাকে তা দেয়া হবে। একমাত্র যেনাকারী ও মুশরিককে নয় (ছহীহ ইবনুল হিব্বান)’।
২। সুনানে ইবনে মাজা শরীফে হজরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- ‘প্রিয় নবী (সা.) এরশাদ করেন- যখন শাবানের মধ্য রজনী উপস্থিত হবে, তখন তোমরা এ রাতটিকে (ইবাদতের মাধ্যমে) উদ্যাপন কর এবং আগত দিনটিকে রোজার মাধ্যমে। কেননা আল্লাহ্ তা‘আলা ওই রাতের সূর্যাস্তের পরক্ষণ থেকেই পৃথিবীবাসীর প্রতি বিশেষ করুণার দৃষ্টি প্রদান করেন এবং এ ঘোষণা দেন- আছ কি কেউ ক্ষমা চাওয়ার? তাকে ক্ষমা করবো। আছ কি কেউ রিজিক প্রার্থনা করার? রিজিক দ্বারা ধন্য করবো। আছ কি কেউ অসুস্থ? তাকে আরোগ্য দান করবো। আছ কি এমন কেউ? আছ কি এমন কেউ? সুবহে সাদেক উদিত হওয়া পর্যন্ত এভাবে বলা হবে (সুনানে ইবনে মাজা)’।
৩। তিরমিজী শরীফে হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন- ‘এক রজনীতে আমি প্রিয়নবীকে বিছানায় খুঁজে পাচ্ছিলাম না। ফলে তাকে খোঁজার জন্য ঘর থেকে বের হলাম। হঠাৎ দেখি তিনি জান্নাতুল বক্বীতে আকাশের দিকে দু’হাত তুলে দিয়ে দোয়ারত আছেন। আমাকে দেখে হুজুর করিম (সা.) বললেন, ‘তুমি কি এ ভয় করছো যে, আল্লাহ ও তার রাসূল তোমার প্রতি অন্যায় করবেন?’ আমি বললাম, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা.)! আমি ভেবেছিলাম আপনি হয়তো আপনার অন্য কোন স্ত্রীর ঘরে প্রবেশ করেছেন।’ তখন হুযূর করীম বললেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’আলা শাবানের মধ্য রজনীতে প্রথমাকাশের দিকে বিশেষ কৃপাদৃষ্টি দান করেন এবং ‘কলব’ গোত্রের ছাগলের পশমেরও অধিক পরিমাণ গুনাহগারকে ক্ষমা করেন ( তিরমিযী শরীফ)।
৪। ‘সুনানে ইবনে মাজাতে হজরত আবু মুসা আশয়ারী থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘প্রিয় নবী (সা.) এরশাদ করেন, নিশ্চয় আল্লাহ তা’আলা শাবানের মধ্য রজনীতে রহমত ভরা দৃষ্টিতে গুনাহগারদের দিকে তাকান, ফলে সকল সৃষ্টিকে ক্ষমা করে দেন, একমাত্র মুশরিক ও অন্য মুসলমান ভাইয়ের প্রতি বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতিরেকে (সুনানে ইবনে মাজাত)।
৫। ‘মুসনাদে আহমদ’এ হযরত আব্দুল্লাহ বিন আমর বিন আছ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত- প্রিয় নবী এরশাদ করেন, সাবানের মধ্য রজনীতে আল্লাহ্ তা‘আলা তার সৃষ্টির প্রতি বিশেষ করুণার দৃষ্টি প্রদান করেন এবং সকল বান্দাকে ক্ষমা করে দেন; কিন্তু দুই শ্রেণীর মানুষকে নয়, বিদ্বেষ পোষণকারী ও আত্মহত্যাকারীকে (মুসনাদে আহমদ)।
৬। হযরত আবু বকর সিদ্দিক্ব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন প্রিয় নবী (সা.) এরশাদ করেন- আল্লাহ্ তা‘আলা যখন শাবানের মধ্য রজনী উপস্থিত হয় তখন পৃথিবীর আকাশে রহমতের দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন এবং সকল শ্রেণির বান্দাদের ক্ষমা করেন, একমাত্র মুশরিক ও মুসলমান ভাইয়ের প্রতি বিদ্বেষপোষণকারীকে ছাড়া (মুসনাদে বাজ্জাজ)।
৭। ‘লাতায়েফুল মা’রেফ’ এ কা’ব থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- ‘আল্লাহ তা’আলা শাবানের মধ্য রজনীতে জিব্রাঈলকে (আ.) বেহেশতের প্রতি এ নির্দেশ দিয়ে পাঠানো যে, বেহেশত যেন নিজেকে নানা সাজে সজ্জিত করে এবং জিব্রাঈল যেন বেহেশতকে উদ্দেশ্য করে এ সুসংবাদ শোনান যে, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমার এ রাত্রিতে মুক্ত করে দিয়েছেন আকাশের তারকারাজির সমপরিমাণ, পৃথিবীর রাত-দিনের সংখ্যা পরিমাণ, বৃক্ষের পত্র-পল্লবের সমপরিমাণ, পাহাড় সমূহের ওজনের সমপরিমাণ এবং বালুরাশির সমপরিমাণ অসংখ্য অগণিত মানুষকে।(পৃষ্ঠা-১৩৮)
৮। ‘মুসনদে বাযযায’ এ হজরত আতা ইবনে ইয়াসার থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘শাবানের মধ্য রজনীতে আয়ু নির্ধারণ করা হয়। ফলে দেখা যায় কেউ সফরে বের হয়েছে অথচ তার নাম মৃতদের তালিকায় লিপিবদ্ধ করা হয়েছে, আবার কেউ বিয়ে করছে অথচ তার নাম জীবিতের খাতা থেকে মৃতের খাতায় লিখা হয়ে গেছে (হাদিস নং: ৭৯২৫)।
৯। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন- পাঁচটি রজনীতে দোয়া প্রত্যাখ্যাত হয় না, জুমার রাত, রজব মাসের প্রথম রাত, শাবানের মধ্য রজনী এবং দুই ঈদের রাত। (‘মুসনদে বাযযায’: ৭৯২৭
১০। ‘মু’জাম আল কাবীর’ এ হযরত মুয়ায ইবনে জবল থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘প্রিয় নবী (সা) এরশাদ করেন- ‘আল্লাহ তা’আলা শাবানের মধ্য রজনীতে স্বীয় সৃষ্টির প্রতি বিশেষ করুণার দ্বার উন্মুক্ত করে দেন এবং সকল সৃষ্টিকেও ক্ষমা করে দেন এবং শুধু মাত্র মুশরিক ও বিদ্বেষীকে ছাড়া (হা-৬৭৭২)।’
১১। অনুরূপভাবে ‘মুজাম আল কাবীর’ এ আবু ছা’লাবাহ্ থেকে বর্ণিত: প্রিয় নবী (সা.) এরশাদ করেন, আল্লাহস্বীয় বান্দাদের প্রতি শাবানের মধ্য রজনীতে করুণা ভরা হৃদয়ে ক্ষমার দৃষ্টিতে তাকান, ফলে মুমিনদের ক্ষমা করে দেন এবং কাফিরদেরকে ইমান আনার সুযোগ দেন আর হিংসুকদেরকে তাদের হিংসার মাঝে ছেড়ে দেন, যতক্ষণ না তারা তাদের হিংসা বিদ্বেষ ত্যাগ করে (হা- ২২৩)।
১২। হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন- নিশ্চয় আল্লাহ তা’আলা শবে বরাতের মধ্য রজনীতে পৃথিবীর আকাশে রহমত অবতারণ করেন এবং পৃথিবীর সকল মানুষকে ক্ষমা করে দেন। একমাত্র কাফের এবং যার অন্তরে বিদ্বেষ বিদ্যমান (ঊসুলু ইতিকাদি আহলিস সুন্নাহ হা :৭৫০)।
সংকলক : লেকচারার, সাদার্ন বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।