কানাইঘাটের ‘হারিয়ে’ যাওয়া হারিছ এখন লন্ডনে
নিউজ ডেস্ক:: ‘চৌধুরী’ ঢাকা থেকে সিলেটের সীমান্তবর্তী এলাকায় গ্রামের বাড়িতে আসা-যাওয়া করতেন হেলিকপ্টারে। গ্রামে অবস্থানকালে এক মুহূর্তের জন্যও বিদ্যুৎ বিভ্রাট ঘটত না। প্রভাব খাটিয়ে বাড়ির ভেতরেই পোস্প অফিস, কৃষি ব্যাংক, মডেল স্কুল, তফশিল অফিস, দাতব্য চিকিৎসালয়, এমনকি পুলিশ ফাঁড়িও স্থাপন করিয়েছিলেন। আশপাশের সব রাস্তা কাঁচা হলেও তাঁর বাড়িতে যাওয়ার আড়াই কিলোমিটার রাস্তা পিচঢালা। বাড়ির ভেতর নির্মাণ করা হয়েছিল নজরকাড়া বাংলো, ছিল চিড়িয়াখানাও। চৌধুরীবাড়ির সেই জৌলুস এখন আর নেই। কারণ বাড়ির ‘প্রাণপুরুষ’ সেই চৌধুরী ৯ বছর ধরে ‘নিখোঁজ’।
এই ‘চৌধুরী’ প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক সচিব আবুল হারিছ চৌধুরী। ২০০৭ সালে দুদকের তৈরি করা দুর্নীতিবাজদের তালিকায় তাঁর নাম ছিল। তদবিরবাজি করে কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ কামানো হারিছ চৌধুরী তালিকায় নিজের নাম দেখেই আত্মগোপন করেন। ভারতে পালিয়ে থেকে সেখান থেকে পরে ইরান, মালয়েশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র হয়ে এখন যুক্তরাজ্যের লন্ডনে অবস্থান করছেন। লন্ডনে বসে ফেসবুকে সরকারবিরোধী প্রচারণা চালিয়ে আসছিলেন। কিন্তু এখন ফেসবুকেও নীরব তিনি।
চারদলীয় জোট সরকারের সময়ে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলার দুটি মামলা, ২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি হবিগঞ্জে সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া হত্যাকাণ্ডে বিস্ফোরক আইনের মামলা ও জিয়া দাতব্য ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলারও আসামি এই হারিছ। হারিছ চৌধুরীর বিরুদ্ধে বড় ধরনের অভিযোগে কমপক্ষে ছয়টি মামলা হয়েছে।
সিলেট জেলার সীমান্তবর্তী কানাইঘাট উপজেলার সড়কের বাজার সংলগ্ন দর্পনগর গ্রামে তাঁর মূল বাড়ি। গত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হওয়ার আগে পর্যন্ত ঢাকার বিজয়নগরে ভাড়া বাসায় থাকতেন। পাঁচ বছরের ব্যবধানে গুলশানে কেনেন চারটি বাড়ি। অস্ট্রেলিয়া ও লন্ডনে কেনেন একাধিক ফ্ল্যাট।
অবশ্য গুলশানের চারটি বাড়ির মধ্যে একটি তাঁর এক ঘনিষ্ঠ ব্যক্তির নামে বরাদ্দ নিয়েছিলেন হারিছ চৌধুরী। দুদকে মামলা হওয়ার পর হারিছের পরিবারের পক্ষ থেকে বাড়িটি ফেরত দেওয়া হয় ২০১৪ সালে।
ঢাকার হাওয়া ভবনের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে দুর্নীতির বরপুত্র হয়ে ওঠা হারিছ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রথম দিকেই আত্মগোপন করেন। এক মাসের বেশি সময় হবিগঞ্জে আত্মগোপনে থাকার পর সিলেট শহরে অবস্থান নেন। তখনই দুর্নীতি দমন কমিশনের শীর্ষ দুর্নীতিবাজদের তালিকায় তাঁর নাম উঠে আসে। একপর্যায়ে ২০০৭ সালের ২৯ জানুয়ারি সিলেটের জকিগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে মামাবাড়ি ভারতের করিমগঞ্জে চলে যান। তাঁর চাহিদা মতো দরকারি কাগজপত্র, দলিল-দস্তাবেজ স্বজনরা বস্তায় ভরে সীমান্তপথে ভারতে তাঁর কাছে পৌঁছে দেয়। হারিছের ঘনিষ্ঠ সূত্র জানায়, ভারত থেকে তিনি প্রথমে লন্ডনে যান। লন্ডন থেকে ইরানে যান তাঁর ভাই আবুল হাসনাত চৌধুরীর কাছে। ইরান থেকে মালয়েশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করে বর্তমানে লন্ডনে আছেন।
সম্প্রতি হারিছ চৌধুরীর আট একর জমিতে গড়ে তোলা বিলাসবহুল বাড়িতে গেলে দেখা যায়, পুরো বাড়িটিই একরকম জনমানবহীন। এত বড় বাড়িতে থাকেন শুধু হারিছের সর্বকনিষ্ঠ ভাই কামাল আহমদ। হারিছের চাচাতো ভাই সিলেট জেলার কানাইঘাট উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী। হারিছ চৌধুরী কোথায় তা জানেন না দাবি করে তিনি বলেন, খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হওয়ার আগে থেকেই হারিছ চৌধুরীর স্ত্রী ও এক ছেলে এক মেয়ে লন্ডনে চলে গিয়েছিল। হারিছরা পাঁচ ভাই। তার মধ্যে ঢাকায় থাকেন সেলিম চৌধুরী, সিলেটের কানাইঘাটের বাড়িতে থাকেন কামাল আহমদ চৌধুরী। কানাইঘাটে তাঁদের বাড়িতে আর কেউ থাকে না।
জানা গেছে, চারদলীয় জোট সরকারের সময়ে বিএনপির কোণঠাসা জ্যেষ্ঠ নেতারা এখনো হারিছের ওপর সংক্ষুব্ধ। হারিছের কারণে ওই নেতারা খালেদা জিয়ার কাছে ঘেঁষতে পারতেন না। তারেক রহমানও হারিছ চৌধুরীর ওপর সংক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলেন। লন্ডন সূত্রে জানা গেছে, ২০১১ সালে লন্ডনে দেখা করতে গেলে তারেক রহমান দেখা দেননি হারিছকে। ঢাকার নটর ডেম কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র শুরুতে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছিলেন। তবে ১৯৭৭ সালে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আহ্বানে জাগদলে যোগ দেন। সিলেট জেলা বিএনপির প্রথম কমিটির সাধারণ সম্পাদক, কেন্দ্রীয় যুবদলের সাধারণ সম্পাদক, সহসভাপতিসহ বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও যুগ্ম মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
তবে সর্বশেষ কাউন্সিলে বিএনপির কোনো পদেই রাখা হয়নি হারিছকে। দেশে ফিরে আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নিলেও ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলার সম্পূরক অভিযোগপত্রে তাঁর নাম থাকায় দেশে ফেরার পরিকল্পনা বাদ দেন তিনি। ২০১২ সালের ৭ ডিসেম্বর হারিছ চৌধুরীর ছোট ভাই সৌদি আরবের আল-রাজি ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা আবুল হাসনাত চৌধুরী ঢাকায় মারা যান। তখন হারিছ ইরানে অবস্থান করছিলেন।
গত নির্বাচনের আগে সিলেট-১ আসনে হারিছ চৌধুরীকে প্রার্থী করার দাবি জানিয়ে পোস্টারিংও করা হয়েছিল। ১৯৭৯ ও ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিলেট-৫ (কানাইঘাট-জকিগঞ্জ) আসনে বিএনপির প্রার্থী হয়ে পরাজিত হয়েছিলেন হারিছ। তবে খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হওয়ায় পরাজয়ের সব গ্লানি মুছে যায়।
হারিছ চৌধুরীর স্ত্রী জোসনা আরা বেগম, ছেলে নাঈম সাফি চৌধুরী ও মেয়ে সামিরা তানজিম (মুন্নু আরা)। মেয়ে ব্যারিস্টার ও ছেলে নরওয়েভিত্তিক একটি তেল কম্পানিতে কাজ করছেন। সর্বশেষ ওয়ান-ইলেভেনের আগে হারিছের সঙ্গে দেখা করতে স্ত্রী-সন্তানরা ঢাকায় এসেছিলেন। হারিছের ইচ্ছা ছিল জাতীয় নির্বাচনে দেশে এসে প্রার্থী হবেন। তবে বিএনপি থেকে কোনো সংকেত মেলেনি।
হারিছের চাচাতো ভাই আশিক চৌধুরী বলেন, ‘নির্বাচন হলে কানাইঘাট-জকিগঞ্জ আসনে জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবুল কাহের চৌধুরী মনোনয়ন পেতে পারেন। আমি নিজেও বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত।’
সূত্র : কালের কণ্ঠ