ভূতের চেয়ে অদ্ভুত

আজকাল পত্রিকার পাতা খুললেই কিংবা টিভি অন করলেই চোখে পড়ে রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি এ ধরনের নানান নীতি নিয়ে বাদ-প্রতিবাদে ভরপুর লেখা কিংবা শোনা যায় কথা। তাই আমি ওদিকে যাব না। আর এসব গভীর বিষয়ে আমার ধারণাও কম। টিভি দেখে এবং পত্রিকা পড়ে মাঝে মাঝে কিছু জ্ঞান লাভের চেষ্টা করি। কারণ রাজনীতি বললে একটা নীতির প্রসঙ্গ আসে। সেই নীতির প্রতি কত জনের প্রীতি আছে আর কত জনের ভীতি আছে বা কতজন সেই নীতিকে ইতি করে দিয়েছেন সে ইতিহাস সবারই জানা।
রাজনীতিতে কেউ গালি খায়, কেউ তালি পায়— তাই রাজনীতির প্রতি কারও প্রীতি বেশি, কারও ভীতি বেশি। শুধু রাজনীতিই নয়, এই ভীতি বা ভয় এবং সংশয় অনেক কিছুতেই হয়। কথায় আছে— লজ্জা, ঘৃণা, ভয় তিন থাকতে নয়। এমন চিন্তা করে ভয়কে জয়, হয়কে নয়, আর নয়কে হয় বা নয়ছয় করার মানুষেরও অভাব নেই এ সমাজে।
জীবন নিয়ে ভয় তো এখন হামেশাই হয়। কেন হয় তা তো প্রতিনিয়ত কাগজের পাতায় দেখছিই। তবে সুজনের জয় আর এসব দুর্জনের পরাজয়ের মাধ্যমেই সমাজ বা দেশ হতে পারে সংশয়মুক্ত, ভয়হীন গৌরবময়। একসময় অনেককেই ভয় দেখানো হতো ভূতের কথা বলে। বলতাম ভূতের ভয়। এখন বড়রা তো দূরের কথা শিশুরাই ভূতের কথা শুনলে হাসে। বরং মানুষ এখন ভয় পায় মানুষকে। কারণ এই মানুষই কখনো সন্ত্রাসী, কখনো খুনি, কখনো দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর, কখনো ধর্ষক হয়ে সমাজের সর্বনাশ করছে।
ঠাকুরমার ঝুলির সেই দৈত্য বা কল্পিত ভূতের চেয়ে মানুষের দৃশ্যমান ভয়ঙ্কর অবক্ষয়— ভয় এবং সংশয়ের জন্ম দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। হিংসা, বিদ্বেষ, ক্রোধ, লোভ, বর্বরতা, নিষ্ঠুরতা, দাম্ভিকতা এসব বদস্বভাবই কেন জানি ভর করেছে সৃষ্টির সেরা জীব মানুষের ওপর। শুধু তাই নয়, আমাদের নিয়ে আর একটি বড় ভয়, আমরা যা বলি তা ঠিক নয়। আমাদের শোনা কথা-বলা কথা, মুখের কথা-মনের কথা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এক নয়। এখন প্রতিশ্রুতির অর্থ দাঁড়িয়েছে ভিন্ন।
কাউকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয়— প্রতিশ্রুতি কাকে বলে, উত্তর হবে— যে কথা কেউ কখনো রাখে না তাকেই প্রতিশ্রুতি বলে। এই ‘কথা দেওয়া’ নিয়ে কোথায় যেন পড়েছিলাম— ‘কথা দিয়ে কথা রাখলে সে আর কথা থাকে না হয়ে যায় কাজ। কাজে আর কথায় ব্যবধান রাখতে হয়। কথা হলো আত্মিক, অনেক উঁচুস্তরের। কাজ হলো কায়িক, অনেক নিচুস্তরের। তাই কথামতো কাজ করলে কথা খেলো হয়ে যায়। ফলে প্রতিশ্রুতির প্রতি মানুষের বিশ্বাসে ভাঙন ধরেছে। প্রতিশ্রুতি যেন এখন শুধুই শ্রুতি। এ নিয়ে একটি গল্প মনে পড়েছে। একটি গ্রামে এক বক্তা নির্বাচনী ভাষণ দিচ্ছিলেন। উপস্থিত জনতার উদ্দেশে প্রতিশ্রুতির বন্যা বইয়ে দিচ্ছেন। রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজ, ব্রিজ-কালভার্ট এমন কিছু নেই যা তিনি করে দেবেন না। আর এসব প্রতিশ্রুতি শুনে খুশি হয়ে এক ব্যক্তি মঞ্চে উঠে পড়লেন, নেতার দিকে একটি কাগজ বাড়িয়ে দিয়ে বললেন—
: আপনার কথা শুনে আমরা খুব খুশি হয়েছি, এবার এই কাগজে একটা দস্তখত দিন।
বক্তা একটু বিরক্ত হয়ে বললেন—
: দস্তখত মানে?
: ওই যে বললেন স্কুল করবেন, জমি দেবেন, রাস্তা করবেন, সবাইকে কাজ দেবেন, গ্রামে আর কোনো অভাব থাকবে না। ওই কথাগুলিই সবার পক্ষ থেকে এই ১৫০ টাকার স্ট্যাম্পে লিখেছি। এখন শুধু একটা দস্তখত আর একটা টিপসই দরকার।
নেতা ক্ষিপ্ত হয়ে গেলেন—
: আমি কী বলেছি তা তো সবাই শুনেছে, দস্তখত দেওয়ার কী হলো?
গ্রামের সেই ব্যক্তি বললেন—
: জিতে গেলে যদি আপনার এসব কথা মনে না থাকে! অনেকেরই তো থাকে না।
নেতা আরও রেগে গেলেন—
: দস্তখত করে কী হবে, অবিশ্বাস করলে আমার কথা রেকর্ড করতেন। চ্যানেলগুলো তো ভিডিও করেছে।
গ্রামের মুরুব্বি তখন বললেন—
: কত কিছুরই তো কত রেকর্ড আছে। কজন তা মূল্যায়ন করে? বলে ভয়েস চেঞ্জ করা হয়েছে, না হয় খণ্ডিত কথা শুনিয়েছে। আপনাদের মতো নেতারা যাতে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করতে না পারে সেজন্য স্ট্যাম্পে লিখে রাখা ভালো। কথা ভঙ্গ করলে মামলা করব। সেজন্যই একটা দস্তখত আর একটা টিপসই রাখা ভালো।
: দস্তখত বুঝলাম কিন্তু আবার টিপসই কেন?
: নইলে যদি বলেন দস্তখত জাল করেছি। ক্ষমতায় গেলে তো আপনাদের অনেক পাওয়ার হবে। পাওয়ারফুল হবেন। তখন তো ইচ্ছা করলেও আপনাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। সেজন্য বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে কাজটা করতে চাই। টিপ দিলেই ন্যাশনাল আইডি পর্যন্ত পৌঁছে যাবে। সবকিছু জাল করা সম্ভব কিন্তু টিপসই তো আর কেউ জাল করতে পারবে না। যাক, এবার স্যার একটু বায়োমেট্রিক পরীক্ষাটা দিয়ে দিন।
গল্প হলেও এর প্রেক্ষাপটের ভিত্তি আছে। কারণ এমন ঘটনা সত্যি আছে। তার পরও আমরা এসব নিয়ে মাথা ঘামাই না। সেজন্যই বলে— আমরা অনেক কিছু শুনি কিন্তু কানে তুলি না। কারণ বহু কিছু আমাদের গায়ে সয়ে গেছে। যুক্তিতে অনেক উক্তি অত্যুক্তি মনে হলেও যুগের বিচারে এখন তা যুগোপযোগী হয়ে গেছে।
যাক, লেখাটা শুরু করেছিলাম মানুষ এখন মানুষকে ভয় পায়। সৃষ্টির এই সেরা জীবকে এখন অনেকেই অন্য প্রাণীর সঙ্গেও তুলনা করে এবং আচরণ বিচারে অনেকেই ওইসব প্রাণীকে মানুষের চেয়ে উত্কৃষ্ট স্বভাবের মনে করে। কারণ স্বভাবদোষী মানুষের স্বভাব সব সময় বোঝা যায় না। কাণ্ডজ্ঞানের অভাবে এদের অভাবনীয় স্বভাবের প্রভাবে অনেকেই ভাবনায় পড়ে যান। অনেক সময় ভাবনায় পড়ে অবুঝ শিশুও। তেমনি একটি শিশুর গল্প শোনা যাক এবার। শিশুটি তার নানার সঙ্গে চিড়িয়াখানা বেড়াতে গেছে। চিড়িয়াখানায় গিয়ে পশুপাখি দেখে শিশুটির মনে অনেক প্রশ্নের উদয় হয়। চিড়িয়াখানার জিরাফের খাঁচার সামনে এসে শিশুটি থমকে দাঁড়ায়। নানাকে প্রশ্ন করে—
আচ্ছা নানা! জিরাফের গলা কত লম্বা অথচ কোনো গলাবাজি নেই, কেন বল তো?
নানা বিরক্ত হয়ে বলল, ওরা কি মানুষ যে গলাবাজি করবে?
নাতি তখন বিজ্ঞের মতো জবাব দেয়—
সেটাই তো চিন্তা করছি নানা, মানুষ এতটুকু ছোট একটা গলা নিয়ে কী পরিমাণ গলাবাজি করে আর তাদের গলা যদি জিরাফের মতো লম্বা হতো তাহলে অবস্থাটা কী হতো?
এভাবে নানা আর নাতি বিভিন্ন পশুর খাঁচার সামনে যায় আর বিভিন্ন মন্তব্য করতে থাকে। বিষয়টি আমি আজ থেকে ১৬ বছর আগে ২০০০ সালের ‘ইত্যাদি’র নানা-নাতির একটি পর্বে তুলে ধরেছিলাম।
চিড়িয়াখানায় বাঘের খাঁচার সামনে গিয়ে নানা উচ্ছ্বসিত হয়ে নাতিকে বলতে থাকে—
দেখছোস্ নাতি এইটা হইতেছে রয়েল বেঙ্গল টাইগার। আর ওই যে ওইডা হইল সিংহের খাঁচা। (সিংহের খাঁচা দেখিয়ে বলে)। দুইটাই খুব ভয়ঙ্কর। যেমন তেজি তেমন হিংস্র। সেইজন্য খাঁচাটা বানাইছে বেশ মজবুত কইরা।
কিন্তু নানা এরা কি মানুষের চাইতেও হিংস্র?
কিসের সাথে কিসের তুলনা করিস? আরে মানুষের কি এত বড় বড় দাঁত আর নোখ আছে?
তা নাই কিন্তু এই বাঘ, সিংহ শুনছি ক্ষুধা না লাগলে শিকার করে না কিন্তু পত্রপত্রিকায়, টেলিভিশনে যে খুনাখুনি আর কোপাকুপির খবর দেখি তা কি বাঘ-সিংহে করে না মাইনষে করে? তুমিই কও তো— তাইলে কারা বেশি হিংস্র?
নানা জবাব খুঁজে পায় না। এরপর হাঁটতে হাঁটতে তারা গণ্ডারের খাঁচার সামনে যায়। গণ্ডারকে দেখিয়ে নাতি বলে ওঠে, আচ্ছা নানা! গণ্ডারের চামড়া বলে মোটা?
হ্যাঁ, তাতে কী হইছে?
কিছু হয় নাই। তবে আমাগো দেশে অনেক মানুষ আছে, যাগো চামড়া তো গণ্ডারের চাইতেও মোটা। গণ্ডারের তো খবর হইতে কয়েক দিন লাগে কিন্তু ওইসব মানুষরে তো বছর বছর ধইরা কইলেও হুঁশ হয় না। তাইলে শুধু শুধু তাদের লগে গণ্ডারের চামড়ার তুলনা করে কেন?
এবারও নানা কোনো জবাব খুঁজে পায় না, পাওয়ার কথাও নয়। কারণ আমাদের স্বভাব এবং সেই স্বভাবে নানারকম প্রভাব ও সেই প্রভাবে বোধবুদ্ধির অভাবের কারণে এসব ঘটতেই পারে। যার প্রভাব পড়ে পরিবারে, পড়ে সমাজে। শুধু নানা-নাতিই নয়, আরও অনেক প্রশ্নের জবাব খুঁজে পাওয়া যায় না। এই ঈদের কথাই ধরা যাক। একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তার ঈদ শপিং দেখে এক কর্মচারী তার মালিকের গাড়ির ড্রাইভারের কাছে জিজ্ঞাসা করে—
আচ্ছা ভাই! স্যার তো এখন অবসরে গেছেন কিন্তু এত এত বাজার করার টাকা পান কই? এখন তো চাকরি নাই।
ড্রাইভার তখন রসিকতা করে জবাব দেয়—
এতদিন ধরে স্যারের সাথে আছো বোঝ নাই? উনি আরও পাঁচ বছর আগে অবসরে গেলেও অসুবিধা হতো না। আমি তো ১০ বছর ধরে স্যারের গাড়ি চালাই, সব দেখেছি। ঘুষ খেয়ে আর দুর্নীতি করে স্যারে জীবনে এত টাকা উপার্জন করেছে যে, সারা জীবন বসে বসে খেলেও শেষ হবে না।
তার মানে অবসরপ্রাপ্ত হইয়াও এত জোর?
ড্রাইভার তখন হেসে বলে—
জোর তো থাকবেই কারণ উনি একজন অবসরপ্রাপ্ত চোর।
তবে আমাদের চেনাজানা এ-জাতীয় লোকদের বলা হয় রাঘব-বোয়াল। গভীর জলের মাছ।
কিন্তু এরা কত গভীর জলের মাছ তা বিষয় নয়। কারণ আজকাল হাঁটুপানির মাছও অনেক অর্থ উপার্জন করতে পারে। এখন চুরিটা লাখ নয়, কোটি নয়— শত এবং হাজার কোটিতে গিয়ে ঠেকেছে। তবে এসব ব্যাপারে মাছের মতো একটা নিরীহ প্রাণীকে উদাহরণ হিসেবে টেনে আনা বোধহয় সমীচীন নয়। শুধু এসব ক্ষেত্রেই নয়, আরও অনেক ক্ষেত্রেই উদাহরণ হিসেবে মাছ বেচারাকে টেনে আনা হয়। কারও আত্মা ছোট হলে বলে পুঁটি মাছের আত্মা। গোপন কথা লুকালে বলা হয় শাক দিয়ে মাছ ঢাকা। কারও চরিত্র বিশ্লেষণে বলা হয়, ভাজা মাছটাও উল্টিয়ে খেতে পারে না। ধরি মাছ না ছুঁই পানি। বাইম মাছের মতো পিছলা ইত্যাদি। বাইম মাছ তো জন্ম থেকেই পিছলা। কিন্তু মানুষ তো জন্ম থেকেই নিষ্পাপ। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে এই মানুষেরই কারও কারও মধ্যে বাসা বাঁধে পাপ। কিন্তু মাছ তা থেকে মুক্ত।
এমনি অনেক কিছুর সঙ্গেই আমাদের আচরণের তুলনা করা হয়। যেমন, অবৈধ পথে অর্থ উপার্জন করে হঠাৎ ধনী হয়ে যাওয়া এক ব্যক্তি সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে আমার এক বন্ধু বলছিল, এদের সবাই আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে।
আর এক বন্ধু প্রতিবাদ জানিয়ে বলল, এদের বেলায় কলাগাছ কথাটা ঠিক নয় কারণ কলাগাছ বেশি মোটা নয়। বলা উচিত আঙ্গুল ফুলে বটগাছ হয়েছে।
কারণ যে আমলে এসব বাগধারা তৈরি হয়েছে তখন চুরির একটা লিমিট ছিল। সেজন্য চিন্তাটা কলাগাছ পর্যন্ত গেছে। এখন হলে বটগাছ, রেইনট্রি, নইলে আরও মোটা যত গাছ আছে সেগুলির সঙ্গে তুলনা করা হতো। অর্থাৎ আঙ্গুল ফুলে বটগাছ, রেইনট্রি, মাদার গাছ, অশত্থ গাছ কিংবা আরও মোটা কোনো গাছ হয়েছে।
আমাদের মাননীয় অর্থমন্ত্রীও বলেছেন, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতের কিছু ক্ষেত্রে যে লুটপাট হয়েছে, তা শুধু পুকুর চুরি নয়, সাগর চুরি। অর্থাৎ এখন চুরি আর পুকুরে সীমাবদ্ধ নেই, সাগর চুরি শুরু হয়েছে।
আসলে ফরমালিনমুক্ত, কার্বাইডমুক্ত, বিষমুক্ত, ভেজালমুক্ত, দুর্নীতিমুক্ত এবং সাগর চুরি মুক্ত এমনি আরও অনেক সমস্যা থেকে আমরা মুক্ত হতে চাই। আমরা টেলিভিশনে, পত্রিকার কলামে, গোলটেবিল আলোচনায়, বক্তৃতায়, বিবৃতিতে নানা ধরনের উপদেশ শুনতে পাই। যারা এসব উপদেশ দেন, তাদের কজন তা মেনে চলেন? হিসাবটা সবারই জানা। তবে উপদেশ দেশভেদে-বেশভেদে-হালভেদে-কালভেদে-অবস্থাভেদে-ব্যবস্থাভেদে-পাত্রভেদে-ছাত্রভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়। উপদেশের ক্রিয়া এবং প্রতিক্রিয়া নানা জনে, নানা মনে, নানা খানে, নানা কানে, নানান অর্থ বা অনর্থ ঘটায়। এবার এ উপদেশ নিয়ে একটি ঘটনা বলেই শেষ করব এই লেখা। কারণ এখানেও মানুষের সঙ্গে পশুপাখির আচরণের তুলনা করা হয়েছে। ঘটনাটি ঘটেছে একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে স্কুল ম্যানেজিং কমিটির চেয়ারম্যানের। শিক্ষক সম্পর্কে অভিযোগ পেয়ে চেয়ারম্যান মহোদয় তার সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে স্কুলের শ্রেণিকক্ষে গিয়ে হাজির। ছাত্র-ছাত্রীর সামনেই তিনি প্রধান শিক্ষককে জেরা শুরু করেন—
মাস্টার সাহেব! আজ কী পড়াচ্ছেন? আপনি তো দেখছি গল্প করছেন?
চেয়ারম্যানের উত্তেজিত ভঙ্গিতে করা প্রশ্নে প্রধান শিক্ষক ছাত্র-ছাত্রীদের সামনে অসম্মানবোধ করেন, তার পরও শান্তভাবে জবাব দিলেন— ওদের ক্লাসের পড়া শেষ স্যার। আমি আসলে অন্য বিষয় নিয়ে, বিশেষ করে চারিত্রিক উৎকর্ষতা, কর্মস্পৃহা বৃদ্ধি, অসততা দূর এসব বিষয় নিয়ে একটু কথা বলছিলাম।
তা ভালো, কিন্তু আমি রিপোর্ট পেলাম আপনি নাকি বিভিন্ন পশুপাখির উদাহরণ দিয়ে ওদের উপদেশ দেন।
জি স্যার।
এটা তো ঠিক নয়।
আপনি কী শুনেছেন জানি না, তবে আমি ওদের চরিত্র গঠনের জন্য কিছু কথা বলি এবং পশুপাখির উদাহরণ দিয়ে যে কথাগুলি বলি তা কিন্তু খারাপ নয়। আপনি অনুমতি দিলে একটু বলি শোনেন—
চেয়ারম্যান খেপে গিয়ে বললেন—
বলেন শুনি।
আমি স্যার এই প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে বিড়াল যেমন অতি সন্তর্পণে ইঁদুর ধরে আমি ওদের তেমন কৌশলে জীবনের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে বলি। আমি ওদের জীবনের সমস্যা লাঘবে বাঘের মতো গর্জে উঠতে বলি। সিংহের মতো সাহসী হতে বলি। অশ্বের মতো বেগবান হতে বলি। উটের মতো কষ্টসহিষ্ণু হতে বলি। পিঁপড়ার মতো পরিশ্রমী হতে বলি। গরুর মতো পরোপকারী হতে বলি। একাগ্রচিত্ত হতে বলি বকের মতো। একতাবদ্ধ হতে বলি কাঁচকি মাছের মতো আর সঞ্চয়ী হতে বলি মৌমাছির মতো।
চেয়ারম্যান আরও ক্ষিপ্ত হলেন—
আপনি কাঁচকি মাছের মধ্যে একতা পেলেন কোথায়?
প্রধান শিক্ষক বললেন—
ওটা স্যার প্রতীকী অর্থে বলেছি। কাঁচকি মাছ পানিতে ঘোরে একসঙ্গে দলবদ্ধ হয়ে। ওরা ধরাও পড়ে একসঙ্গে। ওরা রান্নাও হয় একসঙ্গে। খাওয়াও হয় একসঙ্গে। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত ওরা একতাবদ্ধ।
প্রধান শিক্ষকের প্রতি প্রচণ্ড রেগে গিয়ে চেয়ারম্যান বললেন—
আপনি যাই বলেন এসব আমি মানতে পারছি না। মানুষের আচরণ দিয়েও তো আপনি এসব নৈতিকতার উদাহরণ দিতে পারেন।
হ্যাঁ দিই। বলি, মানুষমাত্রই ভুল করে।
কেন? বিদ্যাসাগরের মতো মাতৃভক্ত হও, হাজী মুহম্মদ মুহসীনের মতো দানশীল হও, মাদার তেরেসার মতো মানুষের সেবা কর— এসবও তো বলতে পারেন?
পারি স্যার, কিন্তু এখনকার মাতৃভক্তি তো মাকে বৃদ্ধ বয়সে ওল্ডহোমে রেখে আসা, দান করা হচ্ছে টিভি ক্যামেরার সামনে ছবি তোলার জন্য, আর মানবসেবার নামে তো আত্মসেবাই করে প্রায় সবাই। আর শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিদের অসম্মান করাটা যেন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে অনেকের। তাই স্যার উদাহরণ দেওয়ার মতো মানুষের সংখ্যা ইদানীং খুবই কম।
যা হোক, প্রধান শিক্ষকের কথা শুনে চেয়ারম্যান কিছুটা চুপসে যান। তবে চেয়ারম্যান মহোদয়কে প্রশংসা করতেই হয় কারণ তিনি উত্তেজিত হলেও ওই শিক্ষককে সবার সামনে কোনো অসম্মানজনক কাজ করতে বলেননি। তাহলে কি এই চেয়ারম্যানের চরিত্র ফুলের মতো পবিত্র?
কথাটি এজন্যই বললাম, আমাদের দেশে অনেকের চরিত্রই নাকি ফুলের মতো পবিত্র। তবে সেই ফুলটি কী ফুল? অর্থাৎ গোলাপ না ধুতরো তার সূত্র কেউই ভেঙে বলেন না। তাই অনেকের এই ফুল মার্কা চরিত্র নিয়ে টানা-দোটানা থেকেই যায়। কারণ এদের অনেকেই সামাজিক নয়, অসামাজিক। এদের নীতিবোধ নৈতিক নয়, অনৈতিক। আর এদের কথাবার্তা কখনো যৌক্তিক নয়, অযৌক্তিক; যা তাদের আচরণকেও প্রভাবিত করে। এই ধরিত্রীতে চরিত্র অর্থাৎ যে চরিত্র থাকলে তাকে চরিত্রবান বলে সেই চরিত্র খুঁজে পাওয়া কঠিন হলেও কিছু ভালো চরিত্রের ভালো মানুষ এখনো আছে।
যাদের কারণেই আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। কথায় আছে— হোক না সে দরিদ্র, আসল হলো চরিত্র। সেই চরিত্রই যাদের দরিদ্র তাদের নিয়ে ভেবে লাভ কী? এরা যতই আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বা বটগাছ হোক না কেন, এদের ছায়াতলে কেউ আশ্রয় পাবে না, কেউ আশ্রয় নেবেও না। কারণ এসব বটগাছও ভুতুড়ে এবং এদের আচরণ ভূতের চেয়েও অদ্ভুত।
লেখক:হানিফ সংকেত, গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, পরিবেশ ও সমাজ উন্নয়ন কর্মী।