বিসিএসে প্রথম হওয়া জুড়ীর ডেইজীর সাফল্যের গল্প
‘প্রথম’। এই শব্দটা সব সময় সবার জন্যই আকর্ষণীয়। সেটা হোক না প্রথম স্কুল, প্রথম দেখা অথবা প্রথম সাফল্যে। আর সেই ‘প্রথম’ শব্দটা যদি বিসিএস পরীক্ষার আগে বসে যায়, তা হলে তো কথাই নেই। এমনটাই হয়েছে ফাহমিদা ফেরদৌস ডেইজীর ক্ষেত্রে। প্রথমবার পরীক্ষা দিয়েই অর্জন করেছেন ৩৫তম বিসিএসে মেধা তালিকায় সারা দেশে প্রথম হওয়ার গৌরব। সাফল্যের পেছনকার রহস্যের অনুসন্ধান করতেই জানা গেল কতটা একাগ্রতা, নিষ্ঠা ও পরিশ্রম জড়িয়ে আছে ডেইজীর সফলতার পেছনে।
ডেইজী এখন একটি স্বপ্নের নাম। দেশের সর্বোচ্চ পরীক্ষা ৩৫তম বিসিএস (বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন) পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ৩ লাখের অধিক পরীক্ষার্থীকে মেধাশক্তি দিয়ে পেছনে ফেলে মেধা তালিকায় তিনি দেশের সেরা নির্বাচিত হয়েছেন। ডেইজী মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার কচুরগুল গ্রামের বাসিন্দা মরহুম হাজি ফখরুল হক ও গৃহিণী ফেরদৌস আক্তারের মেয়ে। পরিবারের ২ বোনের মধ্যে ডেইজী বড়। ছোটবোন ফারজানা ফেরদৌস সেইজী সিলেট মেট্টোপলিটন ইউনিভার্সিটিতে এল.এল.বি ৩য় বর্ষে অধ্যয়নরত। ডেইজী ২০০৬ সালে জুড়ী উপজেলার হাজী ইনজাদ আলী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, ২০০৮ সালে বড়লেখা উপজেলার নারীশিক্ষা একাডেমী ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় কৃতিত্বের সহিত উত্তীর্ণ হন। এরপর উচ্চশিক্ষা অর্জনের স্বপ্ন্ নিয়ে সিলেট সরকারী মহিলা কলেজে অনার্স ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে মেধাক্রম অনুযায়ী সুযোগ পেয়ে যান ইংরেজি সাহিত্য বিষয়ে। কিছুদিন সেখানে তিনি ক্লাস করেন। কিন্তু বাঁধ সাধেন বাবা হাজী ফখরুল হক। প্রবাস থেকে কর্মজীবন সমাপ্ত করে দেশে আসা বাবার স্বপ্ন মেয়ের সময় যাতে নষ্ট না হয় তাই তিনি মেয়েকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবর্তে (সিলেট সরকারী মহিলা কলেজের) ভর্তি বাতিল করে ভর্তি করিয়ে দেন প্রাইভেট ভার্সিটি সিলেট মেট্টোপলিটন ইউনিভার্সিটিতে। ইংরেজী সাহিত্যে এই কলেজ থেকে ২০১৫ সালে কৃতিত্বের সাথে অনার্স-মাস্টার্স সম্পন্ন করেন তিনি।
এরপর থেকে শুরু হয় ফাহমিদা ফেরদৌস ডেইজীর উচ্চশিক্ষা পর্ব। সে সময় ডেইজীর পরিবারের বসবাস ছিল বড়লেখা উপজেলায়। তখন তাঁর বাবা হাজী ফখরুল হক একটানা ১ বছর বড়লেখা থেকে তাদের প্রাইভেট গাড়ীযোগে মেয়েকে নিয়ে যেতেন সিলেট মেট্টোপলিটন ইউনিভার্সিটিতে। এভাবে একবছর যাওয়া আসার পর যাতায়াত অনেক কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ায় তাদের পরিবার সিলেট শহরে একটি ভাসা ভাড়া নেন। তখন থেকে ডেইজীর জীবনে শুরু হয় শিক্ষা জীবনের এক নতুন অধ্যায়। কিন্তু এ অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি না দেখে ২০১৩ সালের ২২ এপ্রিল ইহকালের মায়া ত্যাগ করে ডেইজীদের এতিম করে পরকালে পাড়ি দেন বাবা সৌদিআরব প্রবাসী হাজী ফখরুল হক। সাপ্তাহিক কুলাউড়ার ডাক পত্রিকার বার্তা সম্পাদক শ্রদ্ধেয় এম. মছব্বির আলী ভাইয়ের এপয়েন্টমেন্টের সুবাধে ১৭ অক্টোবর সোমবার বিকেলে ফাহমিদা ফেরদৌস ডেইজীর সিলেটের শিবগঞ্জস্থ বাসায় গিয়ে একান্ত আলাপকালে তিনি তাঁর স্বপ্নগাঁথা কথাগুলো জানান এই প্রতিবেদককে, ফাহমিদা ফেরদৌস ডেইজী বলেন, বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) প্রিলিমিনারী পরীক্ষা দেবার আগ মুহুর্তে আমি সিলেট শাহীন স্কুল এন্ড কলেজে এবং পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে শাইনিং জুয়েল্স নামে একটি প্রাইভেট স্কুলে শিক্ষকতা করেছি। স্কুলে যাবার সময় বিসিএসের বই নিয়ে যেতাম। এবং ক্লাস করার পাশাপাশি বই পড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম। সব শিক্ষকরা অফিসরুমে বসে গল্প করতেন। আর ক্লাসরুম খালি থাকলে আমি সেই রুমে গিয়ে বই নিয়ে পড়াশোনা করতাম। আর যারা আমার সহকর্মী পরীক্ষার্থী আছেন তাদের সাথে বিসিএসের পড়া নিয়ে কথা বলতাম। এবং প্রিলিমিনারী পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতাম এবং প্রতিদিন বিকাল ৪টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত নিজ বাসায় টিউশনি করাতাম। ২০১৫ সালের এপ্রিল মাসে ডেইজী দেশের সর্বোচ্চ পরীক্ষা বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) প্রিলিমিনারী পরীক্ষায় অংশ নেন। পরীক্ষার্থী ছিল ৩ লাখের অধিক। প্রিলিমিনারী পরীক্ষা শেষে লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেন ২০ হাজার ৩৯১ জন। উত্তীর্ণ হন ৬ হাজার।
সবশেষে ভাইবাবোর্ডে প্রায় ২ হাজার জন পরীক্ষার্থী সুযোগ পায়। ২০১৬ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর ৩৫ম বিসিএস পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়। আর এ ফলাফল প্রকাশের মধ্যে দিয়ে দেশের সব পরীক্ষার্থীকে পেছনে ফেলে মেধা তালিকায় প্রথম নির্বাচিত হন মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার কৃতি সন্তান ফাহমিদা ফেরদৌস ডেইজী। ডেইজী জানান, অনেক পরিশ্রম করে এই স্বপ্ন বুনেছি। আমি যে বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছি তা আমি নিজে কখনোই বিশ্বাস করতে পারছি না। যেখানে বিসিএস পাশ করা অনেক কষ্টসাধ্য ব্যাপার, সেখানে আমার এ অর্জন একটি স্বপ্ন বলে মনে করি। সৃষ্টিকর্তা আমাকে যে এত বড় সম্মানে ভূষিত করলেন সেটা আমি কখনোই কল্পনা করিনি। আমার এ ফলাফলের জন্য আমি অনেক আনন্দিত, গর্বিত। আমার এ অর্জনে আমার বাবার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে বাবা বেঁচে নেই। এত বড় আনন্দের সংবাদে আমার পরিবারের সবাই আনন্দে আত্মহারা। কিন্তু এ আনন্দের সাক্ষী হতে পারলেন না আমার বাবা। বাবাকে খুব বেশি মিস করছি। আমার বাবা তাঁর জীবনের সবটুকু উপার্জন করেছেন আমাদের দু’বোনের লেখাপড়ার জন্য।
ডেইজী বলেন, আমি প্রথমেই কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করছি আমার মরহুম দাদা হাজী রকিব আলী মাস্টারকে। তিনি ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। আমার বয়স যখন ২ বছর তখন থেকে দাদা আমাকে অনেক বেশি আদর করতেন। দাদার হাত ধরে আমি সে সময় ৩য় শ্রেণীতে পশ্চিম কচুরগুল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হই। দাদা আমাকে সারাদিন পড়াতেন, এবং অক্ষর শিখাতেন। শৈশবে একমাত্র দাদার কাছ থেকে আমি প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করেছি। এরপর থেকে আমার পরিবারের বাবা-মা অনেক কষ্ট করেছেন আমার লেখাপড়ার জন্য। তারা আমাকে সবসময় পড়ালেখার ব্যাপারে তাগিদ দিতেন, যে ডেইজী তোমাকে অনেক বেশি পড়ালেখা করতে হবে। জীবনকে সুন্দরভাবে সাজাতে হবে। তোমাকে ম্যাজিস্ট্রেট হতে হবে। আমার এ সাফল্যের পিছনে সবচেয়ে বেশি অবদান হল আমার জন্মদাত্রী মা ফেরদৌস আক্তার ও আমার একমাত্র ছোট বোন ফারজানা ফেরদৌস সেইজীর। আমাকে পড়ালেখার ব্যাপারে তারা সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত করতেন। আমি কখনো ভুলতে পারবো না তাদের এই অবদানের কথা। আমার অধ্যবসায়ের জন্য প্রতিটি মুহুর্তে মা ছিলেন আমার পাশে। একেবারে ছোট শিশুর মত আমাকে দেখে শুনে রেখেছেন সারাটা সময়। পড়ালেখা একটু কম করলে আম্মু বখা দিতেন। সারাক্ষণ বই নিয়ে পড়ার টেবিলে পড়ার কথা বলতেন।
একটা সময় যখন খুব কান্তি লাগতো তখন মা আমার হাতে বই দিয়ে বলতেন যখন তোমার ঘুম পাচ্ছেনা তখন তুমি এই বইটা একটু দেখ, আর ঘুম আসলে ঘুমিয়ে পড়বে। রাত ১১টার সময় বই নিয়ে পড়ার টেবিলে পড়তে বসলে কিছুক্ষণ পর ঘুম চলে আসতো। ততক্ষণে আমার মা-চা, কফি, তেঁতুলের আচার ইত্যাদি তৈরি করে দিতেন আমি খাওয়ার জন্য যাতে আমার ঘুম না আসে। বেশির ভাগ সময় পড়তে পড়তে ভোর হয়েছে টের পাইনি কখনো। মা আর বোনও জেগে থাকতো আমার সাথে। আমার ছোটবোন সেইজী ইন্টারনেট থেকে বিসিএসের প্রস্তুতিমূলক প্রশ্ন ডাউনলোড করে লিখে দিত এবং বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে বিসিএসের প্রস্তুতি মূলক প্রশ্ন দিত, সেইজী সেগুলো লিখে রাখতো।
এভাবেই চলতে থাকে আমার পড়ালেখার সংগ্রাম। গতানুগতিক ধারা ভেঙ্গে দিয়ে পাবলিক ভার্সিটির মেধাবীদের পেছনে ফেলে ৩৫ তম বিসিএস পরীক্ষায় মেধা তালিকায় শীর্ষস্থান অর্জনকারী ডেইজী বলেন, সাফল্য পেতে হলে পরিশ্রম আর অধ্যবসায়ের কোন বিকল্প নেই। কঠোর পরিশ্রম আর অধ্যবসায় করলে এ ধরণের ভালো ফলাফল করা যায়। ডেইজী বলেন, আমি দেশের জন্য, দেশের ধনী-গরীব, মেহনতি মানুষের পাশে থেকে তাদের কল্যাণে আমৃত্যু কাজ করে যাব। অনেক স্বপ্ন মনের মাঝে লালন করে আছেন যে, জন্মস্থান জুড়ী উপজেলার শিক্ষা ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে নিজেকে নিবেদিত করার। ফাহমিদা ফেরদৌস ডেইজীর ছোট বেলা থেকেই অদম্য স্বপ্ন ছিল ম্যাজিস্ট্রেট হওয়ার। যাতে তিনি সমাজের পাশে দাঁড়াতে পারেন। সেই স্বপ্নের পিছনেই ছুটতে হয় তাকে, অবশেষে স্বপ্ন এসে ভিড় করে বাস্তবতায়। এখন শুধু অপেক্ষার পালা, কবে ডেইজী ম্যাজিস্ট্রেট হোন। সেই সুদিনের জন্য আমরা অপেক্ষায় রইলাম। ডেইজী সকলের নিকট দোয়া কামনা করেছেন।