সামাজিক অবক্ষয় রোধে নৈতিক শিক্ষা জরুরি
মো. শামসুল ইসলাম সাদিক: : শিক্ষা ও নৈতিকতা একটি অপরটির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সুশিক্ষা ব্যক্তিকে অজ্ঞতার অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে আসে। নৈতিকতা মানুষের জীবনকে সুন্দর, সাবলীল, সমৃদ্ধ ও উজ্জ্বল করে তোলে। ইহার সমন্বয় হলে একজন মানুষ সৎ,আর্দশ, চরিত্রবান, আল্লাহভীরু, দেশপ্রেমিক ও দায়িত্বশীল হয়ে উঠে। বর্তমান সমাজে নৈতিক শিক্ষা অনেক মর্যাদাপূর্ণ। নৈতিকতা হলো ব্যক্তি জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। অবক্ষয় শব্দের আভিধানিক অর্থ ‘ক্ষয়প্রাপ্তি’, সামাজিক মূল্যবোধ তথা সততা, কর্তব্য নিষ্ঠা, ধৈর্য, উদারতা, শিষ্টাচার, সৌজন্যবোধ, নিয়মানুবর্তিতা, অধ্যবসায়, নান্দনিক সৃজনশীলতা, দেশপ্রেমিক, কল্যাণবোধ, পারস্পরিক মমতাবোধ ইত্যাদি নৈতিক গুণাবলী ইত্যাদির অনুপস্থিতিকে বলে সামাজিক অবক্ষয়। মানুষকে ‘মানুষ’ হিসেবে জ্ঞান করতে না পারলে স্বাভাবিক নিয়মেই হারিয়ে যায় মানবিক মূল্যবোধ। হারিয়ে যায় প্রেম, ভালোবাসা, স্নেহ-মায়া ও মমতা। বিনষ্ট হয় শান্তি-শৃঙ্খলা। শুরু হয় মানুষের মধ্যে অশান্তি হানাহানি, মারামারি, কাটাকাটি। বর্তমান বিশ্বে যা হরহামেশাই ঘটছে। মানবতা ও নৈতিকতার কোনো স্তরেই নিরপরাধ মানুষের প্রাণহানি ও অহেতুক রক্তপাত সমর্থন করে না। হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য, প্রতিশোধ প্ররায়ণ অসৎ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য যারা নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করে, তারা মানবজাতি ও সভ্যতার শত্রু। ইসলাম মানুষের জান-মাল রক্ষা করার জন্য সব ধরনের জুলুম, অন্যায় ও রক্তপাত নিষিদ্ধ করেছে। রাসুল (সা:) ইরশাদ করেন- ‘আজ এই পবিত্র দিনে (বিদায় হজের দিন), পবিত্র মাসে এবং পবিত্র (মক্কা) শহরে তোমাদের জন্য যেমন যুদ্ধবিগ্রহ ও অপকর্ম করা অবৈধ, তেমনিভাবে তোমাদের জান ও মাল বিনষ্ট করাও অবৈধ’ (বুখারি ও মুসলিম)। কোথাও কোনো অন্যায় জুলুম ঘটতে দেখলে উচিত নির্যাতিত ব্যক্তির সাহায্যে এগিয়ে আসা। আল্লাহ ইরশাদ করেন- ‘আর যে কারো প্রাণ রক্ষা করল, সে যেন (বিশ্বের) সব মানুষের প্রাণ রক্ষা করল’ (সুরা: মায়েদা, আয়াত- ৩২)। মানুষ সামাজিক জীব। সৃষ্টিগতভাবে সামাজিকতার উপাদান মানুষের মধ্যে রয়েছে। সে ক্ষেত্রে কাউকে নিরঙ্কুশ ও সার্বভৌম ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। পদে পদে মানুষকে অন্যের উপর নির্ভর ও পরমুখাপেক্ষী হতে হয়। তখন মানুষ সামাজিকতার উপাদানগুলো উপেক্ষা করে অসামাজিক হয়ে ওঠে। ক্ষমতার দ্বন্দ্বে, আদর্শিক লড়াইয়ে, পার্থিব জীবনের মোহগ্রস্ত হয়ে মানুষ সংঘাতে লিপ্ত হয়। ইসলামে হত্যা, নৈরাজ্য সৃষ্টি, সহিংসতা ও সন্ত্রাসকে সমর্থন করে না। পৃথিবীতে নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা সম্পূর্ণ নিষেধ। এছাড়াও অশ্লীলতা, পৈশাচিকতা ও আদিম পশুত্বকে প্রশ্রয় ইসলাম দেয়নি। আল্লাহ ইরশাদ করেন- ‘পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করতে প্রয়াসী হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ বিপর্যয় সৃষ্টিকারীকে পছন্দ করেন না’ (সুরা: কাসাস, আয়াত -৭৭)। প্রকৃত মুসলিম সমাজব্যবস্থায় কখনো অশ্লীলতা ও বেহায়াপনার স্থান হবে না। আল্লাহ ইরশাদ করেন- ‘তোমরা ব্যভিচারের কাছেও যেও না। এটা অশ্লীল ও নিকৃষ্ট আচরণ’ (সুরা: বনি ইসরাইল, আয়াত- ৩২)।
নৈতিক শিক্ষার প্রথম ধাপ হচ্ছে পরিবার। সাধারণত মানুষ গৃহ ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা থেকে নৈতিক শিক্ষা লাভ করে থাকে। নৈতিক শিক্ষার মূল ভিত্তি হচ্ছে ধর্মীয় শিক্ষা। ধর্মের মাধ্যমে মানুষ আদব-কায়দা, আচার-আচরণ স¤পর্কে শিক্ষা লাভ করে। রাসুল (সা:) ইরশাদ করেন- প্রত্যেক নর-নারীর পক্ষে জ্ঞান অর্জন করা ফরজ। কারণ, জ্ঞানই মানুষকে ন্যায়-অন্যায়, ভাল-মন্দ, সত্য-অসত্য, পাপ-পূণ্য ইত্যাদির মধ্যে পার্থক্য বুঝতে শেখায়। পরিবারের সদস্যরা যদি নৈতিক হয়, শিশুরাও হয়ে উঠে নৈতিক। প্রতিটি পরিবার যদি নৈতিকতার বিকাশে সোচ্চার হয়, তাহলে নিদ্বির্ধায় আমরা পাব একটি আর্দশ সমাজ। যেখানে অন্যায় থাকবে না। শিক্ষাহীন জাতি মেরুদন্ডহীন প্রাণির মতো। অর্জিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে নিজের জীবনে সফলভাবে প্রয়োগ করাকে শিক্ষা বলে। শিশুদের সঠিক ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে। কারণ ধর্ম হচ্ছে নৈতিক শিক্ষার পীঠস্থান। যার ভেতরে ধমীর্য় জ্ঞান থাকে সে সহজে কোন অন্যায় কাজ করতে পারে না। সমাজে কোন ব্যক্তি প্রতিভাবান কিংবা প্রচুর স¤পদের অধিকারী হতে পারে কিন্তু তার যদি নৈতিক অধ:পতন ঘটে তাহলে সে ব্যক্তি দেশকে কিছু দিতে পারবে না। বিদ্যা অর্জন করলে বা বিত্তশালী হলে মানুষ ভাল-মন্দ বুঝতে পারে এ কথা ঠিক নয়, কেবলমাত্র বিবেক ও নৈতিক শিক্ষা মানুষকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারে। আল্লাহ ইরশাদ করেন- ‘তাদের হৃদয় আছে উপলব্ধি করে না, চোখ আছে দেখে না, কান আছে শুনে না। এরা হলো চতুষ্পদ জন্তুর ন্যায়। বরং তার চেয়েও নিকৃষ্ট । আর এরাই হলো গাফিল’(সূরা: আরাফ, আয়াত-১৭৯)। সমাজ জীবনে নৈতিক শিক্ষার সঠিক প্রয়োগ না থাকায় অপরাধ প্রবণতা বেড়েই চলছে। চাঁদাবাজি, মাস্তানি, ঘুষ, দুর্নীতি, অত্যাচার, অনাচার, জুলুম, নিপীড়ন, শোষণ, নারী নির্যাতন, খুন, গুম, হত্যা, ধর্ষণ, ছিনতাই ইত্যাদি সমাজ জীবনের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। মারাত্মক ব্যাধিরূপে এগুলো সমাজ জীবনকে পঙ্গুতে পরিণত করেছে। শহরে, বন্দরে, গ্রামে-গঞ্জে, হাটে-বাজারে, রাস্তা-ঘাটে চলার পথে কোথাও নিরাপত্তা নেই। এসব ঘটছে নৈতিক অধ:পতনের জন্য। আর এসব থেকে মুক্তি লাভের একমাত্র উপায় হলো নৈতিকতার উন্নতি। এজন্য ধর্মীয় শিক্ষা একান্ত প্রয়োজন।
ইসলামি শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য হলো- মানুষকে নৈতিক শিক্ষা দেওয়া। ইসলামি শিক্ষার মূল ভিত্তি হলো- তাওহীদ, রিসালাত, আখিরাত। যার মধ্যে পরকালের ভয় থাকে এবং তার দ্বারা খারাপ কাজ হতে পারে না। তাই এমনভাবে শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা উচিত, যা গ্রহণ করলে একজন ব্যক্তি দ্বীন ও দুনিয়ার প্রয়োজন মেটাতে পারে এবং সেটাই হবে ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা। সমাজে নৈতিক শিক্ষার সঠিক প্রয়োগ না থাকায় অনৈতিকতার প্রভাবে নৈতিকতা প্রায় বিলুপ্ত পথে। পিতা-মাতা পাচ্ছে না সেবা, সন্তান পাচ্ছে না অধিকার, শিক্ষক পাচ্ছে না সম্মান, ছাত্র পাচ্ছে না সুশিক্ষা। এভাবে খুঁজতে গেলে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অসংখ্য অন্যায় চোখের সামনে ভেসে উঠবে। যার একমাত্র কারণ, নৈতিক শিক্ষার অভাব। রাসুল (সা:) ইরশাদ করেন- ‘নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তি উত্তম যার চরিত্র উত্তম’ (বুখারী ও মুসলিম)। রাসুল (সা:) আরো ইরশাদ করেন- ‘মুমিনের পরিমাপদন্ডে কিয়ামতের দিন উত্তম নৈতিক চরিত্র অপেক্ষা অধিক ভারী বস্তু আর কিছু নয়’ (তিরমিযী)। বর্তমানে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় যে ধরনের ইসলামী দর্শন চর্চা চলে তা দিয়ে কিছুটা নৈতিকতা সৃষ্টি হলেও পূর্ণাঙ্গ নয়। স্কুল পর্যায়ে ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা নামের একটি বিষয় নির্ধারিত থাকলে ও কলেজ পর্যায়ে তা অতিরিক্ত বিষয়। তাও আবার সে অতিরিক্ত বিষয়টি শুধু মানবিক বিভাগের জন্য নির্ধারিত। বিজ্ঞান ও ব্যবসা বিভাগে কলেজ পর্যায়ে ইসলাম চর্চা হয় না বললেই চলে। আধুনিক বিশ্বে ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষাকে মানবজাতির মুক্তির বিধানরূপে পেশ করার যোগ্যতা সম্পন্ন লোক তৈরি করতে হলে জ্ঞান বিজ্ঞানে সকল দিকে শিক্ষা এবং সাহিত্যে ইসলাম, নৈতিকতা মূল্যবোধের প্রাধান্য দিতে হবে। বতর্মানে পৃথিবীর ৪৪.২ শতাংশ মানুষ প্রত্যক্ষভাবে ইন্টারনেটের সঙ্গে সম্পৃক্ত। বিটিআরসির রির্পোট অনুযায়ী দেশে ইন্টারনেট সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা ৪৭.৭৯০ মিলিয়ন অথার্ৎ প্রায় ৫ কোটি। দেশে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা তিন কোটি ছাড়িয়ে গেছে। প্রতি ১২ সেকেন্ড অন্তর একটা করে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খোলা হচ্ছে, যেটা বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশের জন্মহারের থেকেও বেশি। কি করছে এত মানুষ ইন্টারনেটে? অতিমাত্রায় প্রযুক্তির প্রতি আসক্তির ফলে মানুষ হয়ে উঠছে যান্ত্রিক। ফলে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, পরমতসহিষ্ণুতা হ্রাস পাচ্ছে। মানুষ হয়ে উঠছে আত্মস্বার্থোলোভী এবং আত্মকেন্দ্রিক। ফেইক অ্যাকাউন্ট, হ্যাকিং প্রভৃতির ফলে মানুষের ব্যক্তিগত জীবন হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। অল্প বয়সেই ফেসবুক, ম্যাসেনঞ্জার ও মোবাইল ব্যবহারের কারণে শিক্ষার্থীরা খুব সহজেই বিপথে পা বাড়াচ্ছে। ফেসবুকের বিশাল দুনিয়ায়, বন্ধু বান্ধবের অভাব নেই, যাদের অধিকাংশই মুখোশধারী। তারা মিথ্যাচার করে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের অন্ধকারে দিকে ঠেলে দিচ্ছে। শিক্ষার্থীরা তাদের বেশিরভাগ সময়ই ফেসবুকে ব্যয় করছে। ফলে দেখা দিচ্ছে বিপযর্য়। প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহারের ফলে মানসিক অবসাদ সৃষ্টি হচ্ছে এবং নতুন নতুন মানসিক রোগের উৎপত্তি ঘটছে। হতাশার পরিমাণ বাড়ছে এবং কখনো কখনো মানুষ বেছে নিচ্ছে আত্মহত্যার মতো আত্মবিধ্বংসী পথ। তরুণ-তরুণীদের এই অধ:গতির দায় কার? এ দায় আমাদেরই। আমাদের ত্রুটিপূর্ণ সমাজব্যবস্থার। তাই সামাজিক সব অপরাধ দমনে অন্য সব উদ্যোগের পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন নৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রত করা। আসুন জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সব মতপার্থক্য ভুলে সুন্দর একটি জাতি গড়ি। যে জাতি উপহার দেবে সুন্দর একটি সমাজ ও দেশ।
লেখক: শিক্ষার্থী,
এম. সি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ- সিলেট।
মোবাইল : ০১৭২৫-৭২৪৫০৮.