বেলাল হাউজ : স্মৃতিতে অম্লান….।
..নবাব উদ্দিন.
বিলেতের মিডিয়া ও কমিউনিটি জীবনে আমার খুব ঘনিষ্ঠ আপনজন ও বন্ধু শাহাবউদ্দিন আহমদ বেলাল। গত ২৬ জানুয়ারি ছিল তাঁর তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। আজ থেকে তিন বছর পূর্বে অসুস্থ হয়ে তিনি চলে গেলেন এক অজানা ঠিকানায়। যেখানে চলে গেলে আর ফিরে আসা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। চলে গেলেন প্রিয় বেলাল ভাই রেখে গেলেন শুধু স্মৃতি। যখনই মনে পড়ে বেলাল ভাইকে তখনই পুরনো স্মৃতিগুলো দু’চোখের সামনে ভেসে উঠে। জীবন চলার পথে এমন কিছু মানুষের সাথে সাক্ষাৎ মেলে যারা অতিশয় সহজ, সরল, সজ্জন ও সুন্দর মনের অধিকারী। তাঁদের স্মৃতি তাই মনের মুকুরে হৃদয়ের অনুভবে চিরস্থায়ী আসন করে নেয়। বেলাল ভাই এরকম আপনজন ও বন্ধু হিসাবে আমার স্মৃতির ভুবনে সতত আলোকিত সুবর্ণরেখা। বেলাল ভাই ছিলেন বাঙালি কমিউনিটির বিলেতে সসম্মানে টিকে থাকার সংগ্রামের এক শক্তিমান ভিত্তি।তিনি ছিলেন পূর্ব লন্ডনের বাঙালির প্রতিটি আন্দোলনের অগ্রপ্রতীক।
ব্রিকলেন থেকে শুরু করে টাওয়ার হ্যামলেটসের প্রতিটি ব্রিকের মধ্যে লুকিয়ে আছে বেলাল ভাইয়ের কমিউনিটি কর্মকাণ্ডের অবদান। তিনি স্থানীয় কাউন্সিলের কাউন্সিলার হিসেবে নিঃস্বার্থভাবে জনগণের উপকার করেছেন। টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের মিটিংয়ে বাংলা সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন বন্ধের প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন এবং পরবর্তীতে তারই প্রচেষ্টায় পুনরায় বাংলা সংবাদপত্রে কাউন্সিলের বিজ্ঞাপন চালু হয়। তিনি ছিলেন বিলেতে বাংলাদেশি কমিউনিটির স্বাধিকার আন্দোলনের প্রথম কাতারের নেতা। রাজনৈতিক তৎপরতা, সমাজসেবা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড এবং বাংলা সাংবাদিকতা প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তিনি ছিলেন বাঙালি কমিউনিটির অত্যন্ত আপনজন। প্রত্যেকের হৃদয়ের মণিকোঠায় জায়গা করে নেওয়া ব্যক্তিটির নাম শাহাবউদ্দিন আহমদ বেলাল। তাঁর স্মৃতি আমাদের হৃদয়ে জীবিত আছে ও থাকবে চিরকাল।
২০১৮ সালের ২৬ জানুয়ারি সকালে পূর্ব লন্ডনের রয়েল লন্ডন হাসপাতালে আমাদেরকে ছেড়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান তিনি। লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাব পূর্ব লন্ডনের ভেলেন্স রোডে হাসন রাজা কমিউনিটি সেন্টারে ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ প্রিয় বেলাল ভাইয়ের মৃত্যুর স্মরণসভা আয়োজন করে। এই স্মরণসভায় সভাপতিত্ব করেন ক্লাবের তৎকালীন সভাপতি ও সাপ্তাহিক জনমতের প্রধান সম্পাদক সৈয়দ নাহাস পাশা।অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন সংগঠনের সেক্রেটারি মোহাম্মদ জুবায়ের, বক্তব্য রাখেন আহমদ উস সামাদ চৌধুরী জেপি, বর্তমান সভাপতি মো: এমদাদুল হক চৌধুরী, সাবেক কাউন্সিলার সয়ফুল আলম, সাবেক মেয়র গোলাম মর্তুজা, কয়সর আহমদ (বেলাল পুত্র), সাংবাদিক মো আবদুস সাত্তার, সাংবাদিক নজরুল ইসলাম বাসন, সাবেক কাউন্সিলার রাজন উদ্দিন জলাল, তৎকালীন সহ সভাপতি মাহবুব রহমান, সাংবাদিক গবেষক ইসহাক কাজল (প্রয়াত), সাংবাদিক ও কারি লাইফ এডিটর সৈয়দ বেলাল আহমদ প্রমুখ। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে টাওয়ার হ্যামলেটসের মেয়র জন বিগস এবং অতিথি হিসেবে কাউন্সিলর আবদাল উল্লাহসহ সাংবাদিক ও কমিউনিটি নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। স্মরণসভায় আমি আমার বক্তব্যে স্থানীয় কাউন্সিল ও কমিউনিটিতে সাবেক কাউন্সিলর শাহাবউদ্দিন আহমদ বেলালের কাজের অবদানের জন্য মেয়র জন বিগসের কাছে একটি বিল্ডিং বা সড়কের নাম বেলাল ভাইয়ের নামে নামকরণ করার প্রস্তাব রাখি। আমার প্রস্তাব স্মরণসভায় উপস্থিত অতিথিরা সমর্থন করেন। জন বিগস তার বক্তব্যে বেলাল ভাইয়ের অবদানের কথা উল্লেখ করেন এবং আমাদের প্রস্তাবকে সমর্থন করেন । শুধু তাই নয়, মেয়র আমাকে ও প্রেস ক্লাবের নেতৃবৃন্দকে আশ্বাস দেন যে তিনি এবং টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিল বেলাল ভাইয়ের নামে একটি বিল্ডিং বা সড়কের নামকরণ বাস্তবায়নের ব্যাপারে আন্তরিকভাবে কাজ করবেন। এ সভায় পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে কাউন্সিলার আব্দাল উল্লাহও বক্তব্য রাখেন। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন মেয়রের পলিটিক্যাল এডভাইজার সৈয়দ মনসুর উদ্দিন। আমিই প্রথম এই ব্যাপারে প্রস্তাব রাখি।
তারপর প্রায় দেড় বছর কোন সাড়া মেলেনি কাউন্সিল বা মেয়়রের কাছ থেকে। তারপর চ্যানেল এস এর চেয়ারম্যান আহমেদ উস সামাদ চৌধুরী জেপি কমিউনিটির পক্ষ থেকে জন বিগস বরাবর লেখা এক চিঠিতে উল্লেখ করেন, ব্রিটেনে বাংলাদেশি কমিউনিটি বিশেষ করে টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলে মরহুম শাহাবউদ্দিন আহমেদ বেলালের অবদান অনুসরণীয়। ঐ চিঠিতে আরো বলা হয়, তিনি ছিলেন একজন সমাজ সংস্কারক, সংগঠক, রাজনীতিবিদ এবং সাংবাদিক। প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি সফল ও যুগান্তকারী ভূমিকা রাখেন। তাঁর এই অবদান পরবর্তী প্রজন্মের জন্য উদাহরণ হয়ে থাকবে মন্তব্য করে এর স্বীকৃতি দিতে স্থানীয় এলাকার কোন একটি সড়ক বা স্থাপনা তার নামে নামকরণের জন্য চিঠিতে প্রস্তাব রাখেন আহমেদ উস সামাদ চৌধুরী জিপি।
এর জবাবে গত বছরের ৯ জুলাই ২০১৯ লেখা চিঠিতে মেয়র বিগস বলেন, মরহুম শাহাবউদ্দিন বেলাল রাজনীতিবিদ ও সমাজ সংস্কারক হিসাবে যে অবদান রেখেছেন তা অনস্বীকার্য। এমনকি মেয়র উল্লেখ করেন, তিনি যখন প্রথম কাউন্সিলর হয়ে টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের প্রতিনিধিত্ব করতে যান তখন তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন শাহাবউদ্দিন বেলাল কীভাবে এই কমিউনিটির জন্য কাজ করেছেন। তিনি সবসময় ন্যায়ের পক্ষে কমিউনিটির উন্নয়নে কাজ করে গেছেন বলে চিঠিতে উল্লেখ করেন।
মেয়র বিগস চিঠিতে আরো জানান, শাহাবউদ্দিন বেলাল যে ওয়ার্ডের কাউন্সিলার ছিলেন সেই সেইন্ট ডানস্টন ওয়াডের্র আশেপাশে কোন সড়ক বা স্থাপনার নাম যাতে শাহাবউদ্দিন বেলালের নামে নামকরণ করা হয় সেজন্য কাউন্সিলের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তাদের কাছে তিনি অনুরোধ করবেন।
পরবর্তীতে ‘স্বীকৃতি পাচ্ছে শাহাবউদ্দিন আহমদ বেলালের অবদান’ শিরোনামে সংবাদটি সাপ্তাহিক পত্রিকার (ইস্যু ১১২৯: ২৩ – ২৯, ২০১৯) প্রথম পৃষ্ঠায় গুরুত্বসহকারে ছাপা হয়। পত্রিকার সংবাদে উল্লেখ করা হয়- “কমিউনিটির সেবায় বিশেষ অবদানের জন্য তাঁকে সম্মানিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিল। তাঁর নামে টাওয়ার হ্যামলেটসের সেইন্ট ডান্সটন ওয়ার্ডের একটি ভবন কিংবা রাস্তার নামকরণ করার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে কাউন্সিল।”
এছাড়াও বেলাল ভাইয়ের অবদানের স্বীকৃতির জন্য বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তিবর্গ কাউন্সিলের কাছে দাবি তুলেন। বেলাল ভাইয়ের অবদানের স্বীকৃতি যাতে কাউন্সিল তাড়াতাড়ি বাস্তবায়ন করে তার পরিপ্রেক্ষিতে আমি ২৬ আগস্ট ২০১৯ এ মেয়র জন বিগসের বরাবর আবার একটি ইমেইল বার্তা পাঠাই। সেই ইমেইেলের কপি সৈয়দ মনসুর উদ্দিনকেও প্রেরণ করা হয়। আমার ইমেইল বার্তাকে সমর্থন জানিয়ে বর্তমান কাউন্সিলর আব্দাল উল্লাহ জন বিগসকে আরেকটি ইমেইল বার্তা পাঠান। শুধু আব্দাল উল্লাহ নয় শাহাবুদ্দিন আহমদ বেলাল এর ছেলে কয়ছর আহমেদ মেয়র বরাবর আরেকটি ইমেইল পাঠান এবং তার ইমেইলে উল্লেখ করেন- “ প্রিয় জন, আমি নবাব উদ্দিনের ইমেইল এর প্রতিটি শব্দ এবং অনুভূতিগুলোর সাথে সম্পূর্ণ একমত পোষণ করি এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই অগ্রগতিটি দেখার অপেক্ষায় আছি। দয়া করে আমাকে জানাবেন, যাতে আমাদের পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো সাহায্য করতে পারি। অনেক ধন্যবাদ, কয়সর (বেলালের পুত্র।)”
আমি এবং কমিউনিটি এখনো সেই স্বীকৃতির অপেক্ষায় আছি। কয়েক মাস পূর্বে একটি বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পারলাম কাউন্সিলের প্ল্যানিং সেকশনে ‘বেলাল হাউস’ বা ‘শাহাবুদ্দিন বেলাল হাউস’ নামে একটি বিল্ডিং এর নামকরণ এর জন্য প্রস্তাব উপস্থাপন করে। সম্ভবত এই বিল্ডিংটি পূর্ব লন্ডনের স্টেপনি এলাকায়। যে এলাকায় বেলাল ভাইয়ের বাসা।
আমার বিশ্বাস অতি শীঘ্রই মেয়র জন বিগস আমাদের সবার প্রিয় বেলাল ভাইয়ের অবদানের স্বীকৃতির আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেবেন। সেই অপেক্ষায়। এরজন্য মেয়র জন বিগস, আহমদ উস সামাদ, সৈয়দ মনসুর উদ্দিন, কাউন্সিলার আব্দাল উল্লাহ, বেলাল আহমদের পরিবারসহ কমিউনিটির সবাইকে অগ্রিম ধন্যবাদ জানাতে চাই। এই অবদানের স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে আমাদের প্রিয় বেলাল ভাই আমাদের সবার হৃদয়ের মণিকোঠায় জীবিত থাকবেন। তাঁর এই স্বীকৃতি বা প্রাপ্তি আমাদের বিলেতে বাঙালি কমিউনিটির সবার প্রাপ্তি।
বেলাল ভাই আমাদের প্রবাসী বাঙালি কমিউনিটির এক গৌরবের নক্ষত্র। আমাদের সবার প্রিয় বেলাল ভাই অত্যন্ত সরলপ্রাণ, আন্তরিক, বন্ধুবৎসল ছিলেন। তিনি নিঃস্বার্থভাবে জীবনের প্রতিটি সময় সমাজের, কমিউনিটির ও ব্যক্তিবিশেষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন।
বেলাল ভাই আজ নেই। তাকে আমার পাশে না থাকার প্রতিটি মুহূর্ত অনুভব করি। তবে তিনি আমাদের মনের হৃদয়কোঠায় জীবিত আছেন। দুই হাত তুলে দোয়া করছি আল্লাহ তা’আলা যেন বেলাল ভাইকে জান্নাতুল ফেরদাউস এর সর্বোচ্চ স্থান দান করেন। আমিন। ফটো: খালেদ হোসেইন. ****************************************
(লেখক পরিচিতি;- বৃটেনের বিশিষ্ট সাংবাদিক লেখক ও সামাজসেবক নবাব উদ্দিন. লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি. সাবেক সম্পাদক, সাপ্তাহিক জনমত ও
ইস্ট হ্যান্ডস চ্যারিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন.।)