চোখ ভেসে যায় জলে।
জসিম মল্লিক
সেদিন ছিল শুক্রবার। মদিনা ছেড়ে মক্কায় রওয়ানা হওয়ার দিন। মসজিদে নববীতে জুমার নামাজ আদায় করলাম। নামাজ শেষে দুপুরেই এহরাম বেঁধে রওয়ানা হলাম মক্কায়। বাসে আট ঘন্টার জার্নি। বাসের মধ্যে সম্মিলিতভাবে মুর্হুমুহু লাব্বায়িক আল্লাহুমা লাব্বাইক..তালবিয়া ধ্বনি করতে করতে রাতের ঝলমলে পবিত্র নগরী মক্কায় পোৗঁছলাম। রাত সাড়ে এগারোটায় আমাদের জন্য নির্ধারিত হোটেল আল সাফওয়ান রয়্যাল অর্কিডে পৌঁছে গেলাম। দীর্ঘ জার্নি করলেও কোনো ক্লান্তি অনুভূব করছি না। ক্লান্ত হলে চলবে না। হোটেলে চেক ইন করে, ফ্রেশ হয়ে রাতেই যাব ওমরাহ করতে। হজ্জের প্রথম ধাম ওমরাহ। আমার আর জেসমিনের জন্য এক রূম রিজার্ভ। হোটেলে কক্ষে যাওয়ার আগে আমাদের বলে দেয়া হয়েছে কেউ যেনো রুমের জানালার পর্দা না সরাই। কেনো বলেছে সেটা পরে জেনেছি। আমরা মোয়াল্লামের নির্দেশ পালন করি।
রাত দুইটার দিকে সবাই হোটেলের লবিতে মিলিত হলাম। আমাদের গ্রুপের সবাই একসাথে যাব ওমরাহ্ করতে। তাওয়াফ এবং সাফা মারওয়ায় সায়ী করার মধ্য দিয়ে শুরু হবে হজ্জের মূল কার্যক্রম। আমরা হোটেল থেকে বের হয়ে ১ নম্বর গেটের দিকে রওয়ানা হয়েছি। সবাইকে বলে দেওয়া হয়েছে মাথা নিচু করে হেঁটে যেতে। আমরা তাই করছি। লম্বা একটা খোলা চত্বর অতিক্রম করে মসজিদুল হারামে প্রবেশ করলাম। বস্তুত বায়তুল্লার চর্তুপার্শ্বেই যে সুদৃশ্য মসজিদ বিস্তৃত ও উন্মুক্ত আঙ্গিনা দ্বারা পরিবেষ্টিত সেটাই মসজিদুল হারাম। সেখানে দুই রাকাত নামাজ আদায় করলাম। নামাজ শেষে ক্ষানিকটা অগ্রসর হওয়ার পর আমাদের সামনের দিকে তাকাতে বলা হলো। তাকিয়েই চোখের সামনে দেখতে পেলাম সেই বিস্ময়! মহা বিস্ময়! কাবাঘর। যাকে বলে আল্লার ঘর। চোখের সামনে জ্বল জ্বলে করে দন্ডায়মান।
যেনো এটা কেনো বাস্তব ঘটনা না। যেনো সবকিছু স্বপ্নে ঘটছে এমন মনে হলো আমার কাছে। এখন বুঝতে পারছি কেনো হোটেলের পর্দা সরাতে মানা করা হয়েছিল, কেনো মাথা নিচু করে অগ্রসর হতে বলা হয়েছে। আমাদের হোটেলটা এমন জায়গায় অবস্থিত এবং আমাদের রুমগুলো ছিল কাবামুখী তাই জানালার পর্দা সরালেই কাবাঘরের পুরোটা দেখা যায়। আগে ভাগেই যেনো আমরা দেখে না ফেলি তাই সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য পর্দা না সরাতে বা ঢোকার সময় মাথা নিচু করে থাকার জন্য বলা হয়েছিল।
সেই ক্ষনিক মুহূর্তটির অনুভূতি ব্যাখ্যা দেওয়া সত্যি কঠিন। লিখে সেই অনুভূতিকে বোঝানো সম্ভব না আমার পক্ষে। এ এক অন্যরকম শিহরন ছিল, আবেগ ছিল, চোখের জলে ভেসে যাওয়া ছিল। হৃদয় নিংরানো আবেগ উথলে উঠেছিল বুকের ভিতর থেকে। কোথা থেকে এসেছে এই শিহরন, এই আবেগ, এই উদগত কান্নার রোল জানা নাই। লক্ষ মানুষের ভীড়ে সেই মুহুর্তটা ছিল নিজেকে আবিষ্কারের, নিজেকে চেনার। ইশ্বরের প্রতি অকুন্ঠ নিবেদন ছিল। নিজেকে অতি তুচ্ছ মনে হয়েছিল সেই ক্ষনটিতে। জাগতিক জীবন তুচ্ছ হয়ে গিয়েছিল। পরলৌকিক এক জগতে পৌঁছে গিয়েছিলাম। সে এক অসম্ভব অনুভূতি আর শিহরন জাগানিয়া মুহুর্ত। পৃথিবীর সব লোভ লালসা, চাওয়া পাওয়া, মায়া মমতা, স্নেহ ,আকাঙ্খা, কাম সবকিছু অর্থহীন মনে হয়েছিল। এ এমন এক পবিত্রতম স্থান যেখানে পা রাখা সত্যি ভাগ্যের ব্যাপার। সত্যি এক স্বপ্ন।
টরন্টো ১১ মার্চ ২০২১