গেলেন এক সিংহ শার্দুল মুজাহিদ, বড়লেখার মাটি ও মানুষের নেতা।

আব্দুল মান্নান স্যার
⛔⛔⛔⛔⛔⛔⛔⛔⛔⛔⛔⛔
মাস্টার আব্দুল মান্নান। মান্নান স্যার। মান্নান ভাই। এই তাঁর বিশেষন। আজ কবরের বাসিন্দা। মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলায় জন্ম নেয়া এক ক্ষণজন্মা বীরপুরুষ।
সকালেই তাঁর মৃত্যু সংবাদ শুনে নিজেকে বড় অপরাধী লাগছে। দীর্ঘ দিন মান্নান ভাই অসুস্থ ছিলেন। আমি দেখতে যাব যাব বলে যাওয়া হলোনা। গতকালও রাতে ইবনে সিনায় যাব প্লান করেও যেতে পারিনি, আজ যাব বলে। আজো তাঁর জানাযায় যেতে পারলাম না। একরাশ আফসোস, বেদনা হয়তো আমৃত্যু বয়ে চলতে হবে।
দিনভর থামছেনা বৃষ্টি। ঠিক একইভাবে আটকে রাখতে পারছিনা চোখের জল। মান্নান ভাইর দৃশ্যটা ভাসছে চোখে একের পর এক।
আমার এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে মান্নান ভাইর সেদিনকার রিয়েক্ট আজো ভুলতে পারিনা। দৃঢ় কন্ঠে বলেছিলেন, তোমার পরীক্ষার খাতায় কারসাজি করা হয়েছে।
সম্ভবত ১৯৮৯/৯০ সালে কুলাউড়ায় ছাত্রদলের কতিপশ সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের হামলায় আমি আক্রান্ত হই। পরের দিন আন্দোলনের নেতা কর্মী সহ মান্নান ভাই আমাদের বাড়ীতে গিয়ে যে আল্টিমেটাম দিয়েছিলেন।বলেছিলেন, ২৪ ঘন্টার মধ্যে যারা কবীরকে আক্রমণ করেছে তারা আত্মসমর্পণ করে ক্ষমা চাইতে হবে। অন্যথায় ২৫তম ঘন্টায় প্রতিশোধ নেয়া হবে।সেদিন আমি নেতা চিনেছি।
১৯৮৯ সালে বড়লেখা জামে মসজিদে আমার নেতৃত্বে একটি প্রোগ্রাম চলছিল। এসময় ” সোনাই বন্ধু ” নামক সন্ত্রাসী কর্তৃক বাঁধা ও হামলা করা হয়। তার জের ধরে মান্নান ভাইর হুংকার। আমাকে রাজপথের সেনাপতি চিনিয়েছে। যে ঘটনার জের ধরে পাখিয়ালা ভার্সাস তালিমপুর সংঘর্ষ চলে দফায় দফায় তিন দিন।
১৯৮৬ র পার্লামেন্ট নির্বাচন। ছোট্ট একজন স্কুল ছাত্র আমি। আমি যেন সংসদ সদস্য প্রার্থী মান্নান ভাইর রানিংমেট। সভা সমাবেশ মিছিল সবখানে আমি। পথসমাবেশ গুলোতে দীর্ঘ বক্তব্য দিয়ে লোক সমাগম করার দায়িত্ব থাকতো আমার ওপর।
‘ বিলে রক্ত দেব’ স্মৃতি যদি আমার সাথে প্রতারণা না করে তবে খলাগাঁও বাজারে বিশাল নির্বাচনী সমাবেশ। মান্নান ভাই দীর্ঘ বক্তব্য রাখলেন। এক পর্যায়ে বল্লেন, আমি বিলে রক্ত দেব,( যদি সংসদে ইসলাম বিরোধী কোন বিল উত্থাপন হয়) সেদিন একথায় অনেকে টিপ্পনী কাটছিলেন। কত বড় দরিয়া দিল মান্নান ভাইর। ইসলামের জন্য জীবন উৎসর্গ করতেও কোন আপোস নেই তাঁর।
৮৬/৮৭ তে কৈশোরকালে ছাত্ররাজনীতি করবার অন্যতম প্রেরণা মান্নান ভাই। অসম্ভব রকম সৌখিন মানুষ মান্নান ভাই। নানা রংয়ের একরঙ্গা পাঞ্জাবি পরতেন। শাদা, নীল, কলিজি, সবুজ,হলদে,বেগুনী ইত্যাদি রঙ্গিন পাঞ্জাবীতে তাকে বেশ মানাতো। শীতকাল চাদর পরতেন বেশ স্টাইলে। উচ্চতায় একটু কম হলেও গায়ে গতরে আর কন্ঠ ছিল বেশ ভরাট। রেললাইনে দিয়ে আমরা স্কুলে যেতাম। মান্নান ভাইর বাড়ীর পাশে দিয়ে যেতে হত। একসময় মান্নান ভাই যখন বাড়ী থেকে বের হন এই সময়টা ধরলাম।ঠিক সাড়ে ৯ টায় তাঁর বাড়ীর পাশে হাজির হতাম। উদ্যেশ্য মোটরসাইকেল চড়া। তাঁর পেছনে বসে পি সি স্কুল গেইট পর্যন্ত যাওয়া। আহ কত যে আনন্দ! আড়াই মাইল হেটে আধা মাইল মোটর সাইকেল চড়া, কত মজা! তাও মান্নান ভাই র পেছনে। দেখেই বলতেন, কবীর আইছো, চলো।
৮৬’র নির্বাচনের পর মান্নান ভাই কিছুদিন ব্যবসা করেন। লাইব্রেরী ও ক্রোকারিজ সামগ্রীর। মসজিদ মার্কেটের তাঁর এই দোকানটি ছিল রাজনৈতিক নেতা কর্মীর আড্ডাখানা। কর্মী বান্ধব নেতা কি কখনো ব্যবসা করতে পারেন? আমি দেখেছি ৫০ টাকা বিক্রি হলে মান্নান ভাই চা নাস্তা খাওয়াতেন ৪০/৪৫ টাকার। মুলধন, লাভ, লোকসান মান্নান ভাইর খাতায় নেই।
তার খাতায় কেবল কর্মী সমর্থক এর হিসাব।
মান্নান ভাই অবিভক্ত সিলেট জেলা জামায়াতের মজলিসে শুরার সদস্য ছিলেন ১৯৬৫- ৬৭ সালে। স্বাধীনতা পরবর্তী কালে বড়লেখা- কুলাউড়া – ফেঞ্চুগঞ্জ সাংগঠনিক জোনের দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে বড়লেখা থানা ও উপজেলা জামায়াতের আমীর হিসেবে কয়েক দফায় ২০ বছরের ও বেশী সময় দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি একজন সফল শিক্ষক হিসেবেই শিক্ষকতা থেকে অবসর নেন। প্রায় ৫ বছর ধরে তিনি নানা রোগ ব্যাধীতে ভূগছিলেন।
মান্নান ভাইর সাথে আমার আব্বা হুজুর মাওলানা ফরীদ উদ্দীন আহমদ (রাহিমাল্লাহু) এর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিলো। পারিবারিক ভাবে ছিলেন একজন বলিস্ট অভিভাবক। ১৯৯০ সালে আমার একমাত্র বড় বোনের বিয়ের সামগ্রিক
বিষয়ে মান্নান ভাইয়ের ভূমিকা আমৃত্যু অপরিশোধ্য হয়েই থাকবে।
মান্নান ভাই কে নিয়ে স্মৃতির বহর লিখে শেষ করবার মত নয়।
আজ ২৭ জুন রোববার সিলেট ইবনে সিনা হাসপাতালে পৃথিবীর মায়া মমতা ত্যাগ করে মা’বুদের ডাকে সাড়া দেন তৃণমূল রাজনীতির অবিসংবাদিত নেতা আব্দুল মান্নান স্যার।
রাহমানুর রাহিম, গাফুরুর রাহিম আবদুল মান্নান স্যারকে ক্ষমা করে দিও। জান্নাতের উচ্চ মাকামে আশ্রয় দিও। তাঁর যাপিত জীবনের কর্মগুলো নাজাতের জরিয়া হিসেবে কবুল করে নিও।