স্বামীর নির্বাচনে পৈত্রিক বাড়িটি বিক্রি করেছিলেন তিনি,,,,।

মুনজের আহমদ চৌধুরী,
এবাদুর রহমান চৌধুরী। সিলেট বিভাগের জীবিত প্রবীণতম পার্লামেন্টারিয়ান। আসল ভোটের জমানায় নৌকার দুর্গ মৌলভীবাজার-১(বড়লেখা-জুড়ী) আসন থেকে নৌকা ছাড়া চারবার এমপি হয়েছেন তিনি। মন্ত্রীসভায় বড়লেখার প্রথম প্রতিনিধি। আশির দশকে উপমন্ত্রীর মর্যাদায় জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান। এসব শুধু তাঁর রাজনৈতিক পরিচয়। পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় কাটিয়েছেন আইনপেশায়,সুপ্রিম কোর্টের সিনিওর আইনজীবি। সুবক্তা,কবি ও লেখক। বেশ কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়েছে আশি ও নব্বইয়ের দশকে। আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে মৌলভীবাজার থেকে নিয়মিত প্রকাশিত সাপ্তাহিক জনদূতের সম্পাদক।
এ মানুষটি খুব সচেতনভাবেই তাঁর স্ত্রী সন্তানকে সামনে আনেননি। ভোটের রাজনীতিতে প্রচারের হাতিয়ার করেননি। উনার কন্যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বচ্চো ডিগ্রি নিয়ে কেউ ব্যারিষ্টার,কেউ বহুজাতিক প্রতিষ্টানে উচ্চপদে কর্মরত। তারাও খুব সচেতনভাবে বাবা এবাদুর রহমান চৌধুরীর পরিচয়কে কাজে লাগিয়ে রাজনীতিতে রক্তের উত্তরাধীকারের চর্চা করতে আসেননি।
চারবার এমপি,একবার মন্ত্রী,একবার উপমন্ত্রী মিলিয়ে প্রায় ত্রিশ বছর ছিলেন সরকারী দায়িত্বে। ৭৭ বছরের জীবনে ৫২ বছর বাস করেছেন মৌলভীবাজারে। মৌলভীবাজার বারের তারকা আইনজীবি ছিলেন যুগের পর যুগ। অথচ মৌলভীবাজার শহরে উনার কোন বাসা বাড়ী ছিল না। তাঁর স্ত্রী কানিহাটির সম্ভ্রান্ত রাষ্ট্রদুত বাড়ির সন্তান সওদা এবাদ চৌধুরী পৈত্রিকসুত্রে মৌলভীবাজার শহরের সমশেরনগর রোডে একটি বাড়ী পেয়েছিলেন। সে বাড়ীতেই প্রায় ৩০ বছর তারা স্বপরিবারে থাকতেন। ২০০১ সালে ভোটের আগমুহুর্তে নির্বাচনের খরচ যোগাতে এবাদুর রহমান চৌধুরী সেই শতবর্ষী ঐতিহ্যবাহী কাঠের দোতলা বাড়িটি ( এখন যেখানে চট্রগ্রাম স্যানিটারি) মৌলভীবাজারের ধর্নাঢ্য ব্যবসায়ী আকিল আহমেদের কাছে বিক্রি করে দেন। শহরের প্রানকেন্দ্র চৌমুহনায় নানা ইতিহাসের সাক্ষী এ বাড়ির সামনে ছিল এবাদুর রহমান চৌধুরীর চেম্বার, রাজনৈতিক কার্যালয় ও পত্রিকার অফিস।
সওদা এবাদ চৌধুরীর পৈত্রিকসুত্রে পাওয়া সেই বাড়ী বিক্রি করে নির্বাচনে জিতে ২০০১ এ মন্ত্রী হন এবাদুর রহমান চৌধুরী।
আগে তিনবার এমপি,একবার উপমন্ত্রীর মর্যাদায় থেকেও স্ত্রীর বাবার বাড়ি থেকে পাওয়া বসবাসের একমাত্র বাড়ি বিক্রি করে নির্বাচন করার নজীর বাংলাদেশে বিরল। ঢাকায় তারা থাকেন মোহাম্মদপুরে কিস্তিতে কেনা খুব সাধারন একটা ফ্লাটে। এটাই এবাদুর রহমান চৌধুরীর একমাত্র স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ। এবাদুর রহমান চৌধুরীর বিরুদ্ধে কোনদিন কোন আমলে বিন্দুমাত্র দুর্নীতির কোন অভিযোগ করতে পারেনি কোন একজন মানুষও। ওয়ান ইলেভেনের সরকার তন্ন তন্ন করে খুঁজেও তাঁর বিরুদ্ধে কোন দুর্নীতির অভিযোগ পায়নি।
বড়লেখার গ্রাম থেকে জাতীয় পর্যায়ে রাজনীতি করা সৎ,স্মার্ট ক্যারিশম্যাটিক এই জননেতার সহধর্মীনি সওদা এবাদ চৌধুরী কয়েকঘন্টা আগে পাড়ি দিয়েছেন চীরনিদ্রায়,ফিরে গেছেন মহান রবের ডাকে। উনার শেষ ইচ্ছা অনুসারে সিলেটে হজরত শাহজালাল (রহ) দরগাহ মসজিদে আজ বাদ জোহর জানাজা শেষে সংলগ্ন গোরস্থানে দাফন হবে।
এবাদুর রহমান চৌধুরী তাঁর রচিত প্রথম বইয়ের উৎসর্গপত্রে সহধর্মীনি সওদা এবাদ চৌধুরীকে উৎসর্গ করে লিখেছিলেন… যার শুভেচ্ছায় ভিজে নিত্যদিন চলি।
দু একটি ব্যাতিক্রম ছাড়া প্রত্যেক ব্যর্থ পুরুষের জীবনের পেছনে নারীর আখ্যান থাকে। তেমনি সফল পুরুষের পেছনে তার নারীর ত্যাগ,তিতিক্ষা আর সংগ্রামের অধ্যায় থাকে। আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ চার কন্যার ভবিষ্যতের কথা না ভেবে সওদা এবাদ চৌধুরীর মতোন বাবার দেয়া একমাত্র বসতবাড়ী বিক্রি করে স্বামীর নির্বাচনের খরচ জোগানো স্ত্রীদের স্বীকৃতি বা সন্মান জানানো দুরে থাক;স্বীকার করতেও ভুলে যায়। আমরা একজন সফল রাজনীতিবিদকে দেখি,কিন্তু তার নেপথ্যের নারীটি রয়ে যান অন্তরালেই।
সিলেট বিভাগের গত ষাট বছরের রাজনীতির ইতিহাস এবাদুর রহমান চৌধুরীকে বাদ দিয়ে অসম্পুর্ন থেকে যাবে। তেমনি একজন এবাদুর রহমান চৌধুরীর উত্থান এবং উপাখ্যানের উজ্জলতম অধ্যায়ে এই সৌভাগ্যবতী নারী সওদা এবাদ চৌধুরীর নাম স্মরন করি পরম শ্রদ্ধায়।
আমার মরহুম পিতার মতোন সত্য কথা অবলীলায় স্বভাবের সহজিয়ায় সরাসরি বলতে পারা আর একজন অভিভাবক আমার ছিলেন। তিনি চলে গেলেন।
পরপারে ভাল থাকবেন নানী। আপনার শুন্যতা বহুকাল আমাকে আক্রান্ত করবে। আল্লাহপাক আপনার ভাল কাজগুলি কবুল করে আপনাকে জান্নাতবাসী করুন। আমার নানা এবাদুর রহমান চৌধুরী,আপনার চার কন্যা তুলি,বুলি,জহরত ও জান্নাত খালাকে আল্লাহপাক এ শোক সইবার শক্তি দিন। *******************************
-মুনজের আহমদ চৌধুরী, লেখক ও সাংবাদিক,