টুকরো-টাকরা ভাবনা যত (২৪) ঢেউয়ের পরে ঢেউ –বিরামহীন, অন্তহীন!
মুহম্মদ আজিজুল হক
লেখক: চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত-
বাংলাদেশ টেলিভিশন নাটকের স্বর্ণযুগ এখন আর নেই। বিশেষ কোরে বিরল নাট্যপ্রতিভার অধিকারী নন্দিত কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, চলচ্চিত্র নির্মাতা, ও গীতিকার হুমায়ূন আহমেদের অকালমৃত্যুতে সেই স্বর্ণযুগেরও পরিসমাপ্তি ঘটেছে অকালে এবং অত্যন্ত দ্রুততার সাথে। নাটক লেখা ও তা পরিচালনায় অমন সহজাত পারদর্শিতা নিয়ে বোধকরি আর কেউ বাংলাদেশ টেলিভিশনে আসেন নি কখনো। দর্শকদের আকৃষ্ট করার এবং নাটকের মাধ্যমে তাদের উদ্বেলিত করে রাখার অমন স্বভাবজ শক্তি আমি আর কারো মধ্যে লক্ষ্য করি নি। ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদ যেমন দেশে একটি বিশাল পাঠকগোষ্ঠী সৃষ্টি করেছিলেন, তেমনি একজন নাট্যকার, এমনকি একজন চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবেও তিনি অনেক অভিনেতা ও অভিনেত্রীর সহজাত ও অন্তর্নিহিত অভিনয় প্রতিভাকে বের কোরে এনেছিলেন; এবং তা বিকশিত হতে সহায়তা করেছিলেন। মেধাবী ও প্রতিভাবান অভিনয়শিল্পীরা অভিনয়ে তাঁদের পঞ্চেন্দ্রিয় ও বডি ল্যাঙ্গুয়েজ তো ব্যবহার করেনই; এমনকি একটি অতীন্দ্রিয়ের নিগূঢ় ব্যবহার দ্বারা তাঁরা কনটেন্ট-এর গভীরে থাকা সূক্ষ্ম ভাবগুলি তাঁদের অভিনয়ে বিস্ময়করভাবে ফুটিয়ে তোলেন। সেই ক্ষমতার শেকড় যদিও তাঁদের সহজাত বৈশিষ্ট্য হিসেবে জন্ম থেকেই থাকে, কিন্তু সেটিকে বিকশিত করে কাজে লাগাতে তাঁদেরকে অধ্যবসায় সহকারে পরিশ্রম করতে হয়। হুমায়ূন আহমেদের নাটকে অভিনয় কোরে অনেকেই দর্শকনন্দিত ও অবিস্মরণীয় অভিনেতা ও অভিনেত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠালাভ কোরেছেন। অবশ্য, আমি বলছি না যে হুমায়ূন আহমেদের নাটকে অভিনয় করেন নি এমন কোনো শক্তিমান অভিনয়শিল্পী ছিলেন না।
বাংলাদেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলিতে আজকাল হুমায়ূন আহমেদের বহুব্রীহি, অয়োময়, কোথাও কেউ নেই, নক্ষত্রের রাত্, আজ রবিবার, উড়ে যায় বক পক্ষী’র মানের কোনো নাটক দেখতে পাই না। সেটি যদি দর্শকশ্রোতাগণ পেতেন, তাহলে তারা ভারতীয় নাটক বা সিরিয়ালের দিকে ঝুঁকতেন না বলে আমার বিশ্বাস। অবশ্য ভারতীয় চ্যানেলগুলোতে সম্প্রচারিত সিরিয়ালগুলোর দিকে ঝুঁকে পড়ার আরো অনেক কারণ রয়েছে। তবে সেসব আমার এ লেখার বিষয়বস্তু নয়। বাংলাদেশে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলো প্রতিষ্ঠিত হবার পর নাটক নির্মাণের সংখ্যা বেড়েছে, কিন্তু নাটকের গুণগতমান হ্রাস পেয়েছে। নাটকের কনটেন্ট-এরও অবনতি হয়েছে।
মানসম্মত টিভি নাটক তৈরী হচ্ছে খুবই কম। প্রতিভাবান অভিনেতা ও অভিনেত্রী হিসেবেও এখন তেমন কেউ বিকশিত হচ্ছেন ব’লে প্রতীয়মান হচ্ছে না; যদিও প্রচ্ছন্ন মেধা ও প্রতিভা কারো কারো নিশ্চয়ই রয়েছে। প্রয়োজনীয় গাইড্যানস, সাধনা ও পরিশ্রমের অভাবে সেই প্রতিভার পরিপূর্ণ বিকাশ আমরা দেখছি না। আর অতি সহজেই যেহেতু একাধিক চ্যানেলগুলি অভিনয়শিল্পীদের বর্তমান পারদর্শিতা এবং অভিজ্ঞতা নিয়েই তাদেরকে অভিনয় করার সুযোগ দিচ্ছে, তাই অধিকতর উৎকর্ষ অর্জনের অভিলাষ ও আগ্রহে ভাটা পড়ছে। আমাদের এই সময়ের টিভি নাটকগুলো তাই গুণগত মান হারিয়েছে ব্যাপকভাবে। তাই তো আজ আর আলী যাকের, আবুল হায়াত, ড. ইনামুল হক, আসাদুজ্জামান নূর, আবুল খায়ের, ফেরদৌসী মজুমদার, দিলারা জামান, সুবর্ণা মুস্তাফা, শমী কায়সার, লাকী ইনাম, বিপাশা হায়াত, হুমায়ূন ফরিদী, মমতাজউদ্দিন আহমদ, তৌকীর আহমেদ, জাহিদ হাসান, ফজলুর রহমান বাবু, রিয়াজ, শাওন আহমেদ, রাইসুল ইসুলাম আসাদ, আজিজুল হাকিম, প্রমুখের মতো নাট্যাভিনেতা ও নাট্যাভিনে্ত্রী আমরা খুব একটা দেখছি না। সকল সফল অভিনয়শিল্পীর নাম অবশ্য এই লেখার অতি ক্ষুদ্র পরিসরে উল্লেখ করা সম্ভব নয়। অথবা, হয়তো ভুল কোরে অতি বরেণ্য কোনো অভিনেতা বা অভিনেত্রীকে আমি এখানে উল্লেখ করি নি; যেমন করে হুমায়ূন আহমেদের “বহুব্রীহি” নাটকে বৃ্দ্ধ সোবহান সাহেব বাংলাদেশের মাছের তালিকা বানাতে গিয়ে ইলিশ মাছের নামটিই বাদ দিয়ে ফেলেছিলেন। সেক্ষেত্রে আমি নিঃশর্তে ক্ষমাপ্রার্থী। মূলত, আমি টিভি নাটকের একজন সাধারণ এবং অনিয়মিত দর্শক। কিন্তু আমি নাট্যপ্রেমী। বাংলাদেশের টেলিভিশন নাটকের এ সকল দর্শকনন্দিত অভিনয়শিল্পীদের কেউ কেউ ইতোমধ্যে একেবারেই হারিয়ে গেছেন নাট্যজগৎ থেকে; অথবা, যাই যাই কোরে এক পা উঠিয়ে রেখেছেন অনেকে। সেই সত্তুরের দশক থেকে ধারাবাহিকভাবে এসেছেন ঐ সকল প্রতিভাবান ও শক্তিমান অভিনেতা ও অভিনেত্রীগণ। অভিনয়শিল্পীগণ প্রজন্মের পর প্রজন্ম-এর ধারাবাহিকতায়ই আসবেন। আবার চলেও যাবেন; শুধু নাট্যমঞ্চ ছেড়ে নয়; দুনিয়া ছেড়েও; অন্য সকলের মতো। মনে পড়ছে প্র্য়াত নাট্যাভিনেতা আবুল খায়ের, আলী যাকের, এবং সদ্যপ্রয়াত ড. ইনামুল হকের কথা। এসকল খ্যাতিমান নাট্যশিল্পীদের অনেকেই টিভি নাটক থেকে অভিনেতা বা অভিনেত্রী হিসেবে হারিয়ে গেছেন –টিভি নাট্যমঞ্চকে নিঃস্ব কোরে দিয়ে, যদিও তাঁদের হাতে গোনা কয়েকজন এখন আছেন পরিচালনায় বা প্রযোজনায়। বাংলাদেশের টেলিভিশন নাটকের উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক ছিলেন এঁদের প্রত্যকেই। তাঁদের বিদায় টেলিভিশন নাট্যজগতের জন্য ছিল প্রকৃ্ত অর্থেই এক অপূরণীয় ক্ষতি। নাট্যজগৎ থেকে এঁদের একেকজনের হারিয়ে যাওয়া একেকটি নক্ষত্রের পতনের মতো। নাট্যপ্রমী মানুষের নিকট সেটি অতি কষ্টের। কিংবদন্তি অভিনেতা আলী যাকের ও ড. ইনামুল হকের মৃত্যু আমার জন্য ছিল প্রবল মানসিক আঘাত। তাঁদের নিকট থেকে নাটকের দর্শকদের আরো অনেক পাবার ছিল। (আমি এই লেখার পরিসর সীমিত রাখার প্রয়াসে বড় পর্দার বরেণ্য ও প্রতিভাবান অভিনেতা ও অভিনেত্রীদের প্রসঙ্গ টানছি না, যদিও তাঁদেরকে আমি বিস্মৃত হই নি।) সত্তুর বা আশির দশকের খ্যাতনামা অভিনেতাদের প্রায় সকলেই এখন বার্ধক্যের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়েছেন। কবে যে কে চিরতরে হারিয়ে যাবেন তা কেউই জানে না।
প্রজন্মের পর প্রজন্মের এই আসা-যাওয়া। পার্থিব ও জাতীয় জীবনের সর্ব ক্ষেত্রেই। সাগরের ঊর্মিমালার মতো। সাগর-সৈকত থেকে দূরে ঢেউয়ের জন্ম –আলতো কোরে। ক্রমে তা বড় হয়; উঁচু হয়, প্রবল হয়, ধেয়ে আসে সৈকতের দিকে। এরপর বেলাভূমিতে আছড়ে পড়ে সজোরে। তারপর নিলীন হয়ে যায়। উপরোল্লিখিত নাট্যশিল্পীদের প্রত্যেকেই জীবন-তরঙ্গের এক এক পর্যায়ে একেকজন আছেন। নির্মম বাস্তব হলো হারিয়ে যাবেন সকলেই; অন্য সকল সাধারণ মানুষের মতোই; শুধু নাট্যমঞ্চ থেকে নয়, জীবনের মঞ্চ থেকেও।
গতরাতে যখন ঘুম আসছিল না, তখন আমাদের টেলিভিশন নাটকের কুশীলবদের কথাই মাথায় এলো। আমি যদিও নাট্যপ্রেমী, কিন্তু নাটক সম্পর্কে আমার বিশেষ কোনো জ্ঞান নেই। আমি নাটকের একজন সাধারণ দর্শক মাত্র। একটি অন্তর্বাসনা ছিল সেগুনবাগিচাস্থ জাতীয় নাট্যশালার আশেপাশে বাস করবো এবং মঞ্চ নাটকের একজন নিয়মিত দর্শক হবো। বাস্তবে তা হয় নি। ঢাকার কুখ্যাত ট্রাফিক জ্যাম ঠেলে ওখানে যেতে-আসতে আমার ঘন্টা পাঁচেকের মতো লেগে যায়। মঞ্চনাটক দেখার সাধ তাই শিকেয় তুলে রাখতে হয়েছে।
প্রতিভাবান ও বরেণ্য নাট্যশিল্পীগণ যেমন প্রজন্মের পর প্রজন্ম বিলীন হয়ে যাচ্ছেন অসীম কালের বেলাভূমিতে, তেমনি কোরে একই প্রক্রিয়ায় লীন হচ্ছেন দর্শকদের প্রজন্মসমূহ। “সময় বহিয়া যায়।” জীবনও প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ধাবিত হয়। পুরাতন প্রজন্ম বিদায় নেয়, আর নতুন এক প্রজন্মের আগমন হয় এই পৃথিবীর পান্থশালায়। সাগরের বেলাভূমিতে ঢেউয়ের পর ঢেউ এসে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়, কিন্তু সেগুলির পদাঙ্ক অনুসরণ কোরে নতুন ঢেউ আসার অন্ত নেই। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, মধুমতির জল অনাদিকাল ধরে বয়ে চলেছে অকূল সমুদ্রে। পর্বতের মাঝে জন্ম নিয়ে সাগরকামী নদীর এই যে নিরন্তর পথচলা; এর কোনো শেষ নেই। নদীর জলের এই বিরামহীন বয়ে চলা, এ যেন অদৃশ্য সময়স্রোতের এক দৃশ্যমান রূপ। পর্বতমালার অজানা খাদসমূহে জন্ম নিয়ে নদীর যাত্রা অজানা ও অকূল সাগরের উদ্দেশ্যে। একইভাবে, অজানা কোনো জগৎ হতে স্থানান্তরিত হয়ে মানুষের এই পৃথিবীতে আগমন। ক্ষণস্থায়ী এই ধরিত্রীয় জীবনের পর পুনরায় কোনো অজানা গন্তব্যের উদ্দেশ্যে মানুষের প্রস্থান। অনাদ্যন্ত এই ধারা। এর কোনো আদি নেই, এর কোনো অন্ত নেই। “প্রত্যেক প্রাণীকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে।” মরণকে কোনোভাবেই যাবে না এড়ানো। নিষ্পাপ বিহঙ্গ হোক, বা অন্য কোনো প্রাণী, বা নিষ্কলঙ্ক ফুল হোক –সবাইকেই মৃত্যুর পেয়ালায় চুমুক দিতে হবে। মৃত্যুচিন্তা ইদানীং খুব পেয়ে বসে আমায়। ভাবি, মৃত্যুর যদি একটি সহজ ও বেদনাহীন পথ আবিষ্কৃত হতো (পরারোপিত ইউথ্যানেইজিয়ার কথা ভাবছি না।)! ভাবি, কেমন হতো, ভরা কার্তিকের কোনো মায়াবী-জোছনাস্নাত নিশীথে নদীর দু’তীরের বিস্তৃত জনপদ যখন গভীর নিদ্রায় নিষুপ্ত, তখন শ্রীকান্তের বন্ধু ইন্দ্রনাথের মতো ছোট্ট কোনো ডিঙ্গি নৌকোয় কোরে যদি একাকী চলে যেতাম মধুমতির বুকে জেগে ওঠা কোনো ধবধবে শুভ্র নিজন বালুচরে! জলের পার্শ্বে বালুর মাঝে নিষণ্ন আমি। জ্যোৎস্নায় ঝিলমিলে নদীর পানি। অদূরে তুষারশুভ্র কাশবন। কাশবনের ওপর দু’একটি নিশাচর পাখির রহস্যময় ওড়াওড়ি। নিসর্গের এক অখন্ড নিস্তব্ধতার মাঝে শুধু কলকল রবে বয়ে চলেছে আমার প্রিয় মধুমতি। কুহকী সেই পরিবেশে, কোনো বরফের মূর্তির মতো নীরবে ও নির্বেদনায় যদি গ’লে গ’লে আমি মধুমতির স্বচ্ছ সবুজাভ জলের সাথে মিলেমিশে বিলুপ্ত হয়ে যেতাম –এক বেদনাহীন মৃত্যুতে! তাহলে কেমন হতো, ভাবি।
জীবন-মৃত্যুর অপরিহরণীয় প্রক্রিয়ায় পতিত আমরা সমস্ত প্রাণীকুল। তাই মৃত্যু নিয়ে ভীতি থাকলেও কোনো দুঃখবোধ নেই আমার। তবে জন্ম-মৃত্যুর এই বায়োলজিক্যাল ট্র্যাপে ঢুকিয়ে মৃত্যুযন্ত্রণার অবশ্যম্ভাবিতায় ফেলে দেয়ায় স্রষ্টার ওপর আমার এক গভীর অভিমান আছে। “খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে বিরাট শিশু তুমি আনমনে।….” বুকের গহীন ভেতর থেকে একটি দীর্ঘশ্বাসের সাথে বেরিয়ে আসে একটি প্রশ্নঃ ‘আমাদেরকে নিয়ে স্রষ্টার এই নিঠুর খেলা কেন?’ কে তার জবাব দেবে?