ওয়েলসের প্রয়াত ফার্ষ্ট মিনিষ্টার “রডরি মর্গান”স্ট্যাচু নির্মাণের জন্য ফান্ড রেইজিং ইভেন্ট অনুষ্ঠিত,।

দেওয়ান ফয়ছলঃ এই লেখার শুরুতেই ওয়েলসের প্রয়াত ফার্ষ্ট মিনিষ্টার রাইট অনারেবল মি: রডরি মর্গান এর রাজনৈতিক জীবন এবং কি ভাবে তিনি ওয়েলসের মানুষের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হলেন তা নিয়েই একটু আলোচনা করবো।
রাইট অনারেবল রডরি মর্গান ১০ বছর ওয়েলসের ফার্ষ্ট মিনিষ্টার হিসেবে সবচেয়ে দীর্ঘতম সময় দায়িত্ব পালন করেন। লেবার পার্টির একজন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ হিসেবে তিনি ফার্ষ্ট মিনিষ্টার অব ওয়েলস এবং লিডার অব ওয়েলস হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ২০০০ থেকে ২০০৯ সাল পর্য্যন্ত। এ ছাড়াও তিনি কার্ডিফ ওয়েষ্ট-এ এসেম্বলী মেম্বার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ১৯৯৯ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্য্যন্ত এবং কার্ডিফ ওয়েষ্ট এর মেম্বার অব পার্লামেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ১৯৮৭ সাল থেকে ২০০১ পর্য্যন্ত। তিনি ৭৭ বছর বয়সে ২০১৭ সালের ১৭ই মে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন।
তিনি ছিলেন ওয়েলসবাসীর সুখে দু:খের আপনজন। তাঁর জীবন যাত্রা ছিলো অতি সাধারণ মানুষের মতো। তিনি ওয়েলসের বিভিন্ন জায়গা ঘুরে বেড়াতেন, বিভিন্ন ধরণের ফার্মের মালিকদের বাড়িতে গিয়ে তাদের খোঁজ খবর নিতেন। তাদের ফার্ম (খামার) কি ভাবে চলছে, কি ভাবে আরও উন্নতির দিকে নিয়ে যওয়া যায় ইত্যাদি নিয়ে আলাপ আলোচনা করতেন। এরপর তিনি অফিসে যাওয়ার পর কেবিনেট মেম্বারদের সাথে আলাপ আলোচনা করে ফার্মগুলোর মালিকদের সরকারের পক্ষ থেকে কি ভাবে সাহায্য, সহযোগিতা করা যায় তা নিয়ে আলোচনা করে তা বাস্তবায়ন করতেন। এ ভাবেই তিনি ওয়েলসকে একটি মডার্ণ ওয়েলসে পরিণত করার ব্রত নিয়েই কাজ করে যান আজীবন, আর এ জন্যই তাঁকে ’ফাদার অব ডিভোলিউশন’ উপাধিতে আখ্যায়িত করেন ওয়েলসের জনগণ।
রাইট অনারেবল মি: রডরি মর্গান ওয়েলবাসীর জন্য নি:স্বার্থ ভাবে কাজ করে যাওয়ার স্বীকৃতি স্বরূপ তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে একটি স্ট্যাচু নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়। এ্ই স্ট্যাচুটি নির্মাণ করা হবে কার্ডিফ বে’র ’সেনেড’ (ওয়েলস পার্লামেন্ট) এর সামনে। বাংলাদেশী কাউন্সিলার দিলওয়ার আলী হচ্ছেন এই স্ট্যাচু নির্মাণের পরিকল্পনাকারী। তিনিই প্রথম উদ্যোগ নেন এই স্ট্যাচু নির্মাণের। তাঁর উদ্যোগে রডরি পরিবার, বন্ধু-বান্ধব এবং কমিউনিটি লিডারদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করে সর্বসম্মতিক্রমে অফিসিয়্যালি ’রডরি মরগান স্ট্যাচু ফান্ড’ গঠন করা হয়।
ফান্ডের প্রথম উদ্বোধনী অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয় ’দি সেনেড-এ’ ২০১৯ সালে। এ উপলক্ষ্যে প্রথম ফান্ডরেইজং অনুষ্ঠিত হয় কার্ডিফ সিটি হলে। উক্ত অনুষ্ঠানে বিভিন্ন অর্গেনাইজেশন এবং ব্যক্তিগত পর্য্যায়ে দানকৃত ৪৮ হাজার পাউন্ড সংগৃহীত হয়। এরপর বিভিন্ন সংগঠন ফান্ডরেইজিং করে আরও ৩৫ হাজার পাউন্ড ফান্ডে জমা হয়।
রডরি মর্গান স্ট্যাচু কমিটির প্রোজেক্ট কো-অর্ডিনেটর কাউন্সিলার দিলওয়ার আলী জানিয়েছেন, এই স্ট্যাচু নির্মাণ কাজে ব্যয় হবে মোট ১২৫ হাজার পাউন্ড।
প্রথম ফান্ড রেইজিং করার পরপরই তারা আরেকটি ফান্ড রেইজিং এর জন্য ডিনার পাট্র্রি আয়োজন যখন শুরু করেন তখনই শুরু হয়ে যায় ভয়াল করোনার থাবা। এ ভাবে চলে যায় দু’বছর। এখন অবস্থা স্বাভাবিক হওয়ার পর গত ২২ সেপ্টেম্বর নর্থ ওয়েলসের রেক্সহামে এক ফান্ডরেইজিং ডিনার পার্টির আয়োজন করা হয়। উক্ত অনুষ্ঠানকে সফল করে তোলার লক্ষ্যে ওয়েলসের ক্রস পার্টি থেকে রাজনৈতিক সহযোগিতা, ওয়েলসের ইউনিভার্সিটিগুলো, ব্যবসায়ী মহল সহ অনেকেই এগিয়ে আসেন। বেনগর এবং রেক্সহাম গিলিনডর ই্উনিভার্সিটি উক্ত ডিনার পার্টিতে চাঁদার ব্যাপারে অগ্রণী ভুমিকা পালন করে যা দেখে আবারসিৎ ইউনিভার্সিটিকেও উৎসাহিত করার ফলে তারাও বিশেষ অনুদান প্রদান করে। উক্ত ডিনার পার্টিতে মোট ১৪ হাজার পাউন্ড সংগ্রীহিত হয়। এখন পর্য্যন্ত মোট ৯৭ হাজার পাউন্ড তাদের সংগ্রহ হয়েছে। এখন তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আগামীতে লন্ডন এবং এডিনবারাতেও ফান্ড রেইজিং ডিনারের আয়োজন করার।
কার্ডিফ এর কাউন্সিলার দিলওয়ার আলী বলেন.’আমরা অনেক আগেই নর্থ ওয়েলসে ডিনার পার্টির আয়োজন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রম করোনার প্রকোপের জন্য তা করতে না পারায় পিছিয়ে গেলাম। আমি অত্যন্ত আনন্দিত যে, সাড়ে তিন বছর পূর্বে এই প্রোজেক্ট শুরু হওয়ার পর থেকে এখন পর্য্যন্ত সবাই যে স্ট্যুচু নির্মাণে একাগ্রচিত্তে কাজ করে যাচ্ছেন তা দেখে। এতে পরিস্কার বুঝা যায, রডরি মর্গানের অবদান ওয়েলসের ইতিহাসে সাক্ষী হয়ে থাকবে।”
রেক্সহামের এম এস এবং নর্থ ওয়েলসের মিনিষ্টার লেসলি গ্রিফিথস বলেন, আজকের এই আকর্ষণীয় রডরি মর্গান ফান্ড রেইজিং সন্ধ্যায়, ওয়েলসের জন্য রডরি যে অবদান রেখে গেছেন তারই যেন এক বিরাট উৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আমি আশা করছি, সে দিন আর বেশি দূরে নয়, সেনেড এর সামনে ’ফাদার অব ডেভোলিউশন’ এর স্ট্যাচু মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে।
জুলি মর্গান এম এস বলেন, “পেন্ডেমিকের কারণে অনেক পিছিয়ে গেলেও কাউন্সিলার দিলওয়ার এবং স্ট্যাচু ফান্ড রেইজিং কমিটির সদস্যবৃন্দ তারা যে এই প্রজেক্টকে কৃতকার্য্য কর্রা জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন এজন্য আমি তাদেরকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।”
তিনি আরও বলেন, ওয়েলসের ব্যাপারে রডরি ছিলেন খুবই আবেগ প্রবণ, যার ফলে পুরো ওয়েলসের প্রতিনিধিত্বকারী ওয়েলস পার্লামেন্ট (বর্তমানে সেনেড) তা অনুধাবন করে, এবং এই আপিল ওয়েলসের সব এলাকাগুলোতে পৌছে যাবে।”
মূলত: সমাজের জন্য ভালো কাজ করে গেলে তার মূল্যায়ন একদিন হবেই এই সত্য কথাটি আমরা বুজতে পারিনা। আমি প্রায়ই যখন আমার বন্ধু-বান্ধবের সাথে কথা বলি, যারা হচ্ছেন সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ, তাদের কথা থেকে বুঝা যায় তারা সমাজের জন্য এত কিছু করে যাচ্ছেন অথচ তার কোন মূল্যায়ন নেই। তাদের এ সব কথা শুনতে শুনতে একদিন এক জনকে বললাম শুনেন, আপনি যে কাজ করে যাচ্ছেন, আপনি যদি মনে করেন সমাজের জন্য ভালো কাজই করছেন, আপনি সমাজের জন্য নিবেদিত প্রাণ ব্যক্তি তা হলে মনে রাখতে হবে, আজ হোক আর কাল হোক আপনি তার মূল্যায়ন পাবেনই। এমন কি মারা যাওয়ার পরেও হয়তো আপনি দেখে যেতে পারবেন না কিন্তু আপনার ভবিষ্যৎ বংশধর তা দেখবে, তারা আপনার জন্য গর্ববোধ করবে।
তিনি উত্তরে বললেন, বেঁচে থাকতেই যদি জনগণের কাছে আমার মূল্যায়ন দেখে যেতে না পারি, তা হলে এ মূল্যায়নের কি দরকার। সাথে সাথে আমি বললাম, আমার কাছে মনে হচ্ছে, আপনি জনগণের কাছ থেকে মূল্যায়ন পাওয়ার জন্য কাজ করছেন, মূলত: তাদের জন্য আন্তরিক ভাবে কাজ করছেন না। আপনি একজন নামকরা মানুষ হতে চান এটাই আপনার মূল লক্ষ্য! তা হলে আমার মনে হয় এই ধারণা নিয়ে জনসেবা না করাই উচিত। যারা সমাজের জন্য নিবেদিন প্রাণ ব্যক্তি তারা কোন দিনই কোন কিছু পাওয়ার আশায় কাজ করেনা এ কথাটি আপনার স্মরণে রাখা উচিৎ। এরপর তিনি এ ব্যাপারে আর কোন কথা বলেন নি, মনে হলো যেন একটু লজ্জা পেয়েছেন।
উদাহরণ দিয়ে বলেছিলাম আজ দেখেন, রডরি মর্গান স্ট্যাচু বানানো হচ্ছে। মি: মরগান কোন দিনই আশা করেন নি যে, আমাকে জনগণ বাহবা দিক। তিনি কাজ করেছেন নি:স্বার্থ ভাবে। তাঁর লক্ষ্যই ছিলো ওয়েলসকে একটি মডার্ণ ওয়েলসে পরিণত করা, যার ফলে ওয়েলসের মানুষ বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা গ্রহণের মাধ্যমে একটি সুখী সমৃদ্ধশালী সমাজ গড়ে ওঠবে।
বন্ধুকে বললাম, ওয়েলসের অনেক ইতিহাস আমি জানি। আগেকার দিনের ওয়েলস আর বর্তমান দিনের ওয়েলস এর মধ্যে কত পার্থক্য হয়েছে এবং দিন দিন কত এগিয়ে যাচ্ছে তা থেকে আমাদের শিক্ষা নেয়া উচিৎ। এ কথা অনস্বীকার্য যে, ওয়েলসের এই অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছিলো রাইট অনারেবল মি: রডরি মর্গানের সময় থেকেই। তার এই কর্মফলের সুবাদেরই ওয়েলসের মানুষ তাঁর স্ট্যাচু নির্মাণ করে তাঁকে ইতিহাসের পাতায় স্থান করে দিচ্ছে।
লেখকঃ দেওয়ান রফিকুল হায়দার , সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিষ্ট ও সদস্য লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাব