বাংলাদেশের শর্তেই রাজি আইএমএফ, হৃদয়ভাঙার বেদনায় আহত বিএনপি ও সুশীল সমাজ।

আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহের মাঝে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অর্থনীতির ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। ক্ষুদ্র অর্থনীতির দেশগুলো পড়েছে চাপের মুখে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। করোনা পরিস্থিতিতে অনেক বৃহৎ অর্থনীতির দেশের পরিস্থিতি নাজুক হয়ে পড়েছিল যখন, তখনও বাংলাদেশ শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল অর্থনীতি এবং মানুষের জীবন-জীবিকা। তবে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের ঢেউ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এসে লেগেছে। কারণ, ইউক্রেন এবং রাশিয়া উভয় দেশের সাথেই বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। এমন অবস্থায় অর্থনীতি টিকিয়ে রাখতে কৌশলী ভূমিকা নিতে হয়েছে সরকারকে। বাংলাদেশে নিয়োজিত অন্যতম বৃহৎ আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা আইএমএফ-এর কাছে ঋণ চেয়েছে সরকার।
আর এই খবর শুনে ‘দেশ শ্রীলঙ্কা হয়ে গেছে রে…’ বলে আনন্দে বগল বাজাতে শুরু করে বিএনপি-জামায়াতসহ দেশবিরোধী বিভিন্ন গোষ্ঠী। বাংলাদেশ এতটাই দরিদ্র হয়ে গেছে যে, হাত পাততে হয়েছে- এমন বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়াতে শুরু করে তারা। আর তাদের কথায় বিশ্বাস করে দেশের কিছু অশিক্ষিত মানুষও বিভ্রান্ত হয়েছে। অথচ অশিক্ষিতরা জানে না, ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা থাকলেই কেবল ঋণ দেয় উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলো। আর যেসব দেশ দেউলিয়া হয়ে যায় বা দ্বারপ্রান্তে, তাদেরকে ঋণ দেওয়া হয় এমন শর্তের ভিত্তিতে, যা সেসব দেশকে পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে ফেলে। অথচ বাংলাদেশ আইএমএফ থেকে ঋণ পাচ্ছে কোনো ধরণের শর্তের চাপ ছাড়াই। আইএমএফ যেসব ক্রাইটেরিয়া মেনশন করেছে, তা বাংলাদেশ সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনারই অংশে আগে থেকেই উপস্থিত।
সংবাদসূত্রে জানা গেছে, আইএমএফ বাংলাদেশকে ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ দিতে সম্মত হয়েছে। সরকার এবং আইএমএফ-এর পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়া হয়েছে ইতিমধ্যে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বাংলাদেশকে ৩টি আলাদা কর্মসূচির আওতায় ৪২ মাসে ৭ কিস্তিতে এই ঋণ দেবে। প্রথম কিস্তি পাওয়া যাবে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে। পরের ৬ কিস্তি পাওয়া যাবে ২০২৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে। এই ঋণ প্রাপ্তি নানা দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ। প্রথমত, এই ঋণ বাংলাদেশের সম্ভাব্য অর্থনৈতিক সঙ্কট মোকাবেলায় বড় ভূমিকা রাখবে। দ্বিতীয়ত, এই ঋণের ফলে অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা যেমন- বিশ্বব্যাংক, এডিবি থেকেও বাংলাদেশের ঋণ প্রাপ্তি সহজ হবে। কারণ, আইএমএফ-এর ঋণ পাওয়ার ক্রাইটেরিয়াই সবচেয়ে কঠিন। আর তৃতীয়ত, এই ঋণ প্রাপ্তির অনুকূলে সরকারকে কিছু অর্থনৈতিক নীতিমালার সংস্কার করতে হবে, যা বাংলাদেশের জন্য প্রয়োজন ছিলো এবং কিছু প্রক্রিয়াধীন ছিল আগে থেকেই। এসব সংস্কার দেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
আইএমএফ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যেসব সংস্কার দেখতে চায়, সেগুলো বাংলাদেশের অর্থননৈতিক পরিকল্পনারই অংশ ছিল। তাই এভাবেও বলা যায়, বাংলাদেশের শর্তেই আইএমএফ রাজি। এসব প্রস্তাবনার মধ্যে রয়েছে- ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মধ্যে সকল কর অঞ্চলে উৎসে আয়কর কাটার জন্য স্বয়ংক্রিয় চালান ব্যবস্থা চালু। ই-গভর্নমেন্ট প্রকিউরমেন্ট সিস্টেমের বাস্তবায়ন। বিদ্যুৎ সঞ্চালন প্রকল্পে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে অনুমতি দেওয়া। সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমে সুবিধাভোগীদের শনাক্তে ডেটাবেজ ব্যবহার করা। লোকসানে থাকা চিনিকলগুলো বন্ধ করে দেওয়া। এই বছরের মধ্যে সংসদে নতুন আয়কর বিল পাস করা। বার্ষিক ৪ লাখ টাকার বেশি ব্যয়কারীদের জন্য বাধ্যতামূলক রিটার্ন জমা দেওয়া। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, রাজস্ব, সামাজিক সুরক্ষা পরিকল্পনা, স্বাস্থ্য ও শিক্ষাখাতের মতো সামাজিক ব্যয়ের সময়সীমার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ। সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইন ও ভ্যাট আইন পাস করা। কার্বন ট্যাক্স প্রবর্তন ইত্যাদি। এসব প্রস্তাবের অধিকাংশই সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনায় আগে থেকেই রয়েছে, কিছু কিছু ইতিমধ্যে চলমান। অর্থাৎ ঋণ প্রাপ্তির ক্রাইটেরিয়ার কোনোটিই বাংলাদেশের প্রতিকূলে তো নয়, বরং এসব কার্যক্রম সম্পন্ন হলে লাভটা হবে বাংলাদেশেরই।
অথচ বাংলাদেশ যেন ঋণ না পায় সেজন্য বিশেষ মহল ষড়যন্ত্রে নেমেছিল। যাদের মধ্যে বাংলাদেশের সুশীল সমাজের উপস্থিতি ছিল লক্ষ্যণীয়। হুট করে রাজনীতিবিদ হওয়া গণঅধিকার পরিষদ নেতা মার্কিন দালাল রেজা কিবরিয়া বলেছিলেন, আইএমএফ বাংলাদেশকে ঋণ দিবে না। বাংলাদেশ যেন ঋণ না পায় এজন্য বদিউল আলম মজুমদার কলাম লিখেছেন। তিনি বলেছেন, ঋণ প্রাপ্তির জন্য বাংলাদেশকে রাজনৈতিক সংস্কার করতে হবে। অথচ আইএমএফ কখনই রাজনৈতিক বিবেচনায় ঋণ দেয় না; রাজনৈতিক বিষয় আইএমএফ-এর এজেন্ডা বহির্ভূত বিষয়। তবুও বদিউল আলম এমন দাবি করেছিলেন যেন বাংলাদেশ ঋণ না পায়।
বাংলাদেশের ঋণ প্রাপ্তির বিষয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির জন্য সিপিডিও ভূমিকা রেখেছিল। সিপিডির ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বাংলাদেশের অর্থনীতির নানা সঙ্কটের কথা তুলে ধরে ঋণ প্রাপ্তির প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি ও আইএমএফ-এর কাছে নেতিবাচক ধারণা তুলে ধরার চেষ্টা করেন। ঋণ প্রাপ্তির পথে বাধা সৃষ্টির চেষ্টা করেছিল টিআইবি। তারাও বাংলাদেশে সুশাসনের অভাব, অর্থনৈতিক সংস্কার ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করে ঋণ প্রাপ্তিকে বাধাগ্রস্ত করতে চেয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই সমস্ত বাধা আইএমএফ পাত্তা দেয়নি। বরং আইএমএফ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির প্রশংসা করেছে।
আইএমএফ-এ চাকরি করেছেন বলে কথায় কথায় রেজা কিবরিয়া বিভিন্ন টকশোতে নিজেকে জাহির করেন। এমনকি বিশ্বের অন্যতম সফল অর্থমন্ত্রী হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন অর্থনৈতিক ফোরাম ও অর্থনীতি বিষয়ক গবেষণা সংস্থা থেকে খ্যাতি লাভ করা বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রীর যোগ্যতা নিয়ে পর্যন্ত জঘন্য ও নোংরা মন্তব্য করেন রেজা কিবরিয়া। তার দাবি, বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রীর নাকি যোগ্যতাই নাই আইএমএফ থেকে ঋণ নেওয়ার বিষয়ে। রেজা কিবরিয়ার এসব বক্তব্যকে বিএনপি-জামায়াতপন্থী বুদ্ধিজীবীরাও সমর্থন করে মাথা নাড়েন, তার সুরে সুর মিলিয়ে প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারে কলাম লিখেন তারা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেল আইএমএফ এই তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের সকল অপচেষ্টা তুড়ি মেরে উড়িয়ে এবং তাদের হৃদয় ভেঙে দিয়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতার প্রশংসা করে পাশে থাকার প্রত্যয় জানিয়েছে।
অর্থনৈতিক সক্ষমতার বিচারে এশিয়ার ইমার্জিং টাইগার খ্যাত বাংলাদেশ আজ বিশ্বে উন্নয়নের রোলমডেল। তাই বাংলাদেশের অবস্থা যে শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্থানের মতো না, সে বিষয়টি আইএমএফ-এর পক্ষ থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া, আইএমএফ এও বলেছে, করোনা পরিস্থিতির পর বাংলাদেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছিল এবং আবার আগের মতো এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
দেশের অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আইএমএফ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে যেসব সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছে, তা অত্যন্ত গ্রহণযোগ্য এবং দেশের অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক। যেমন- আইএমএফ বারবার বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি কমাতে বলেছে। সরকারও বিভিন্ন সময় বলছিল ভর্তুকি দিয়ে গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবরাহ করা কঠিন হয়ে উঠেছে। এখন আইএমএফ-এর এসব শর্তের কারণে সরকারের জন্য পরিকল্পনা বাস্তবায়ন অত্যন্ত সহজ হবে। ব্যাংকিং খাতেও সংস্কারের কথা বলছে আইএমএফ, যা সরকার নিজেই উদ্যোগ নিয়েছে ইতিমধ্যে।
কাজেই বলা যায়, একরকম বিনা শর্তেই বাংলাদেশ আইএমএফ-এর ঋণ পেয়েছে। বিএনপি-জামায়াতসহ দেশবিরোধী গোষ্ঠী চেয়েছিল বাংলাদেশ যেন ঋণ না পায় এবং অর্থনৈতিক সঙ্কট তৈরি হয়। তাহলে সরকারের ওপর চাপ তৈরি হবে, দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আর তাতে সাধারণ মানুষ ফুঁসে উঠবে। মূলত দেশের ক্ষতি করে হলেও সরকারের পতন ঘটাতে চেয়েছিল দেশবিরোধী এবং সুশীল শ্রেণি। কিন্তু আইএমএম-এর ঋণ প্রাপ্তির ফলে বরং সরকারের জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হলো। সুশীল শ্রেণি এতে হৃদয় ভাঙার বেদনায় আহত হয়েছেন, সেটা বলাই বাহুল্য।